‘আমি পাপিষ্ঠা। ব্যভিচারিণী।’
আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আঁৎকে উঠলেন। কী বলছে এ নারী? তার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? সবার সামনে এভাবে কেউ নিজেকে ব্যভিচারিণী বলে সাব্যস্ত করে? তার কি লোকলজ্জার ভয় নেই? সে কি জানে না ব্যভিচারের শাস্তি? সোজাকথায় মৃত্যুদণ্ড!
মেয়েটি তবু থামছে না। রাসুলের সামনে, আরও কয়েকজন সাহাবির সামনে সে অকপট বলছে— হে আল্লাহর রাসুল, আপনি আমাকে গোনাহ থেকে পবিত্র করে দিন। আমি ইচ্ছাকৃতভাবে মহাপাপ করে ফেলেছি। কামনার তাড়নায় আমি ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছি। আপনি আমাকে শাস্তি দিয়ে পবিত্র করে দিন। পরকালের ভয়াবহ শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। আমি অনুতপ্ত, আমাকে শরিয়তের শাস্তি দিয়ে পবিত্র করুন।
মদিনায় এমন ঘটনা এই প্রথম, কোনো নারী নিজে এসে স্বীকার করছে তার ব্যভিচারের পাপ। গোনাহ থেকে পবিত্র হতে মাথা পেতে নিতে চাইছে অমোঘ মৃত্যুর সাজা। তাই ঘৃণা নয়, শাস্তি প্রয়োগের বেদনায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইচ্ছা করেই মেয়েটির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। মেয়েটি কান্নাজড়িত নয়নে আবার রাসুলের সামনে গেলো। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এবার অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
মেয়েটি আবার সেদিকে গিয়ে অনুনয় করতে লাগলো— তাকে শাস্তি দেয়া হোক। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আবারও অন্যদিকে মুখ ফেরালেন।
এভাবে আল্লাহর রাসুল চারবার তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন, যাতে মেয়েটি তার সামনে থেকে চলে যায়। যাতে সে তার পাপের কথা গোপন করতে পারে। যাতে সে অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে নিজেকে শুধরে নিতে পারে। যাতে সে এক পুণ্যবতী রমণী হয়ে মানুষের মাঝে বাঁচতে পারে। পরকালের ফয়সালা না হয় আল্লাহ রাহমানুর রাহিমই নির্ধারণ করবেন!
মেয়েটি কিছুতেই মানছে না। পাপের অনুশোচনায় সে এমনভাবে দগ্ধ হয়েছে, আল্লাহর শাস্তির ভয়াবহ আঁচ তার অন্তকরণ এমনভাবে ঝলসে দিয়েছে, পরকালের কঠিন শাস্তির চেয়ে দুনিয়ার শাস্তি তার কাছে তুচ্ছ বলে মনে হচ্ছে।
আল্লাহর রাসুলের সামনে কাতরকণ্ঠে বলতে লাগলো, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি জানি এ পাপের শাস্তি কতো ভয়াবহ! পাথর ছুঁড়ে মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু তারপরও সেই শাস্তি স্বেচ্ছায় বরণ করে নিতে আমি প্রস্তুত আছি। দুনিয়ার এই সামান্য শাস্তির চেয়ে আখেরাতের শাস্তি অনেক ভয়াবহ, সীমাহীন যন্ত্রণাদায়ক। তাই দয়া করে আপনি দুনিয়ার শাস্তি কার্যকর করে আখেরাতের অসহনীয় শাস্তি থেকে আমাকে পরিত্রাণের ব্যবস্থা করে দিন। নইলে আমি সারাটি জীবন এক দুঃসহ যাতনা বয়ে বেড়াবো। অনুশোচনার অনুতাপ আমাকে পলেপলে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। আখেরাতে আল্লাহর সামনে আমি আপনার সুপারিশ নিয়ে দাঁড়াতে চাই।
মেয়েটির অস্বাভাবিক কাতর অনুনয়, তার অনুতাপের প্রত্যয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ব্যথিত করলো। তিনি ব্যথা ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে কঠোর হলেন। মেয়েটিকে বললেন, তুমি এই ভরমজলিসে স্বেচ্ছায় তোমার অপরাধের কথা বারবার স্বীকার করেছো। তাই তোমার উপর শাস্তি কার্যকর করা যেতে পারে। কিন্তু যেহেতু তুমি এখন গর্ভবতী, তাই তোমার মৃত্যুদণ্ড এই মুহূর্তে কার্যকর করা যাবে না। কারণ, তুমি দোষী হলেও তোমার গর্ভের সন্তান দোষী নয়। সে নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ ও পবিত্র। তোমার কারণে তার প্রাণদণ্ড হতে পারে না।মেয়ে, তুমি এখন চলে যাও। তোমার সন্তান জন্ম নেয়ার পর তুমি আবার এসো। তখন তোমার শাস্তির ব্যাপারে ফয়সালা করা হবে।
মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো। আহ্! অনুশোচনা!!
নয় মাস পর।
মদিনায় একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হলো। আর দশটা সাধারণ শিশুর মতোই জন্মের পর সে তীব্র চিৎকার করে ঘোষণা দিলো তার পৃথিবীতে আগমনের সংবাদ। কচি হাত-পা নেড়ে অন্যসব নবজাতকের মতোই সে জানান দিলো, তার ক্ষুধা পেয়েছে। কিন্তু শিশুটি জানে না, তার মা একজন ব্যভিচারিণী। সে ব্যভিচারের ফসল। তার মায়ের মাথার ওপর ঝুলছে পাথরছোঁড়া মৃত্যুদণ্ড!
শিশুটি এসবের কিছুই জানে না। শিশুদের সবকিছু জানতে নেই। শিশুদের সবকিছু জানাতে নেই। তারা বেহেশতি ফুলের মতো পবিত্রতা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে, তাদেরকে পবিত্র রাখতে হয়।
জন্মদাত্রী মা সন্তান জন্ম দিয়ে একবার আকুল নয়নে তাকালো নাড়ীছেঁড়া সন্তানের দিকে। অনেকটা সময় নিয়ে দেখলো। চোখজুড়ানো কমলকান্তি মুখাবয়ব। দু’হাত বাড়িয়ে দিলো কোলে নেয়ার জন্য। পরক্ষনেই গুটিয়ে নিলো হাত।
না, এই পাপহাতে সে ছোঁবে না তার পবিত্র শিশুকে। তার পাপের কালিমা সে লাগাবে না তার সন্তানের শরীরে। মদিনার পুণ্য আলো-বাতাসে সে বড় হোক পুণ্যমানুষের সান্নিধ্যে। তার পাপী স্পর্শ যেনো কোনো প্রভাব না ফেলে তার সন্তানের দেহ-মনে।
জন্মদাত্রী কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এলো আঁতুড়ঘর থেকে। মদিনার অলিগলি পার হয়ে পৌঁছলো রাসুলের আঙিনায়। বুকের মধ্যে কান্না আটকে ডাকলেন— ইয়া রাসুলাল্লাহ! পাপিষ্ঠা হাজির! ব্যভিচারিণী উপস্থিত আপনার চরণতলে। আমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। এখন আমি গর্ভ থেকে মুক্ত। আমার ওপর প্রয়োগ করুন শরিয়তের শাস্তি। শাস্তি দিয়ে পবিত্র করুন আমাকে ও আমার সন্তানকে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তার সামনে এলেন। বেদনায় মোচড় দিয়ে উঠলো ভেতরটা। জন্মদাত্রী মাকে প্রবোধ দিলেন, সান্ত্বনা দিলেন। তাকে শান্ত হতে বললেন।
মেয়েটি শান্ত হলে তিনি তাকে বললেন, মেয়ে, যাকে তুমি জন্ম দিয়েছো সে তোমার সন্তান। তোমার গর্ভে তার জন্ম। তোমার গর্ভের কোনো পাপ নেই। তোমার সন্তানেরও কোনো পাপ নেই। যাও, ফিরে যাও। তাকে ভালোভাবে লালন-পালন করতে থাকো। তাকে দুধপান করাও। তোমার বুকের দুধে সে বেড়ে উঠুক। তোমার বুকের দুধে কোনো পাপ নেই। সে যখন দুধপান করা ছেড়ে দিয়ে অন্য খাবার গ্রহণ করতে শিখবে, তার জীবনধারণ করার ক্ষেত্রে তোমার উপর নির্ভরশীল থাকবে না, নিজে নিজে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারবে, তখন তুমি আসবে। আর আমি তোমার উপর শরিয়তের বিধান কার্যকর করবো, শাস্তি প্রদান করবো।
মেয়েটি আবার আশায় বুক বাঁধলো। আবার আশাহত হলো। অনুতাপের আগুনে তাকে আবার পুড়তে হবে কতো রাত, কতো দিন- কে জানে!
বাড়ি ফিরে এলো সে। ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো তার দুগ্ধপোষ্য সন্তান। বুকে আগলে রাখেন তাকে। মাঝে মাঝে ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন মোলায়েম শরীরের শিশুটির দিকে। মায়ের দিকে তাকিয়ে খলবলিয়ে হেসে উঠে সে। যেনো চেষ্টা করে মায়ের চেহারার বিষাদ দূর করতে। মায়ের মুখের বিষাদ তবু সরে না।
***
দিন যায়। মাস যায়।
জন্মদাত্রী মা সন্তানকে দুধপান ছাড়িয়ে অন্যান্য খাবারের দিকে মনোনিবেশ করে। আস্তে আস্তে সে মাকে ছাড়াই এটা-সেটা খেতে শুরু করে। খাওয়ার জন্য নিজের চাহিদা মাকে জানাতে শেখে।
ততোদিনে সব ধরনের আবেগ-অনুরাগ চলে যাওয়ার কথা মায়ের। হুঁশে ফিরে স্বাভাবিক জীবনের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার কথা, জীবনের উপর মমতা জন্ম হওয়ার কথা। কিন্তু না, আখেরাতের ভয়ে সে তখনও ভীত, কোনো পরিবর্তন নেই। সন্তান প্রসবের আড়াই বছর পর যেখানে সন্তানের স্নেহমায়ায় নিজেকে আরও জড়িয়ে নেওয়ার কথা, তার ভালোবাসায় ডুবে যাওয়ার কথা। যেখানে আদালতে তার অপরাধের কোনো মামলা নেই, নথিপত্র নেই; নেই কোনো তথ্য-প্রমাণ, কোনো সাক্ষী, একটু চাইলেই নিজেকে বাঁচিয়ে নেয়ার সমস্ত উপকরণ বিদ্যমান, সেখানে একমাত্র আখেরাতের শাস্তির ভয়ে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ও জীবনদানে প্রস্তুত সে। উদগ্রীব দুনিয়ার শাস্তি বরণ করে আখেরাতের মুক্তির জন্য।
আড়াই বছর পর।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম-এর দরোজায় আবার এক সকালে কড়া নড়ে উঠলো— ব্যভিচারিণী হাজির! তাকে শরিয়ত মোতাবেক পাথরছোঁড়া শাস্তি দিন হে আল্লাহর রাসুল!
কোলে আড়াই বছরের নিষ্পাপ শিশু তার। শিশুর মুখে রুটির টুকরো, যাতে উপস্থিত সকলে বুঝতে পারে- তার সন্তান আর তার বুকের দুধের উপর নির্ভরশীল নয়। সে এখন অন্য খাবার খেয়ে জীবন ধারণ করতে সক্ষম। সে না থাকলেও তার কোনো সমস্যা হবে না।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আবার সবিনয় নিবেদন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনার সঙ্গে প্রতিশ্রুত অঙ্গীকার অনুযায়ী আমি এসে উপস্থিত হয়েছি। সকল শর্ত পূর্ণ হয়ে গেছে। শরিয়তের বিধান কার্যকর করতে এখন আর কোনো বাধা নেই। তাই দয়া করে দ্রুত আমাকে পবিত্র করুন। দুনিয়ার সামান্য শাস্তির বিনিময়ে আখেরাতের অফুরন্ত শাস্তি থেকে আমাকে রক্ষা করুন।
মদিনার বাতাস কি স্তব্ধ ছিলো কিছুক্ষণের জন্য? মদিনার নরোম দিলের লোকদের চোখগুলো কি আজ একটু বেশি কেঁদেছে? মদিনার খর্জুরবীথিকা-বনে আজ সবুজেরা কেমন নিষ্প্রভ! কোথায় সেই আড়াই বছরের শিশুসন্তানটি, আম্মি আম্মি বলে যে ডাকতো তার মাকে?
অবশেষে রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম শরিয়তের বিধান কার্যকর করার নির্দেশ দিলেন এবং পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলো সেই সে পাপিষ্ঠা মেয়েটির। ইতিহাস যার নাম বলেনি অনাগত পৃথিবীর কাছে।
***
মেয়েটির জানাজা সমাগত। মদিনার নবি, আমার রাসুল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং তার জানাজা নামাজ পড়ানোর জন্য সামনে অগ্রসর হলেন। তার দু’চোখ অশ্রুর জলে টলটলায়মান। তিনি আজ ইমাম। নামাজ পড়াবেন এক ব্যভিচারিণীর।
হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর চোখও ভেজা। হাত ধরে ফেললেন আল্লাহর রাসুলের। জিজ্ঞেস করলেন— মুর্শিদ আমার, এ মেয়ে ব্যভিচারিণী। অথচ আপনি নিজে তার জানাজা নামাজ পড়াতে যাচ্ছেন! আমায় বলুন রহস্যের অন্যূন উচ্চারণ!
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বড় বেদনা নিয়ে তাকালেন ওমরের দিকে। দ্বিধাহীনকণ্ঠে বললেন, হে ওমর, মেয়েটি ব্যভিচারিণী। সে পাপিষ্ঠা। গর্হিত তার অপরাধ। কিন্তু সে এমন আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে তওবা করেছে যে, যদি সেই তওবার দশ ভাগের এক ভাগও গোটা মদিনাবাসীর মাঝে বণ্টন করে দেয়া হতো, তাহলে সমস্ত মদিনাবসীর গোনাহ মাফ হয়ে যেতো।
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এগিয়ে গেলেন সামনে। উচ্চকণ্ঠে তাকবির দিলেন— আল্লাহু আকবার! তার উচ্চারণের সঙ্গে সমস্ত মদিনাবাসী উচ্চারণ করলো— আল্লাহু আকবার! আল্লাহুম্মাগফির লি হায়্যিনা ওয়া মায়্যিতিনা...।
আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আঁৎকে উঠলেন। কী বলছে এ নারী? তার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? সবার সামনে এভাবে কেউ নিজেকে ব্যভিচারিণী বলে সাব্যস্ত করে? তার কি লোকলজ্জার ভয় নেই? সে কি জানে না ব্যভিচারের শাস্তি? সোজাকথায় মৃত্যুদণ্ড!
মেয়েটি তবু থামছে না। রাসুলের সামনে, আরও কয়েকজন সাহাবির সামনে সে অকপট বলছে— হে আল্লাহর রাসুল, আপনি আমাকে গোনাহ থেকে পবিত্র করে দিন। আমি ইচ্ছাকৃতভাবে মহাপাপ করে ফেলেছি। কামনার তাড়নায় আমি ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছি। আপনি আমাকে শাস্তি দিয়ে পবিত্র করে দিন। পরকালের ভয়াবহ শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। আমি অনুতপ্ত, আমাকে শরিয়তের শাস্তি দিয়ে পবিত্র করুন।
মদিনায় এমন ঘটনা এই প্রথম, কোনো নারী নিজে এসে স্বীকার করছে তার ব্যভিচারের পাপ। গোনাহ থেকে পবিত্র হতে মাথা পেতে নিতে চাইছে অমোঘ মৃত্যুর সাজা। তাই ঘৃণা নয়, শাস্তি প্রয়োগের বেদনায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইচ্ছা করেই মেয়েটির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। মেয়েটি কান্নাজড়িত নয়নে আবার রাসুলের সামনে গেলো। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এবার অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
মেয়েটি আবার সেদিকে গিয়ে অনুনয় করতে লাগলো— তাকে শাস্তি দেয়া হোক। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আবারও অন্যদিকে মুখ ফেরালেন।
এভাবে আল্লাহর রাসুল চারবার তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন, যাতে মেয়েটি তার সামনে থেকে চলে যায়। যাতে সে তার পাপের কথা গোপন করতে পারে। যাতে সে অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে নিজেকে শুধরে নিতে পারে। যাতে সে এক পুণ্যবতী রমণী হয়ে মানুষের মাঝে বাঁচতে পারে। পরকালের ফয়সালা না হয় আল্লাহ রাহমানুর রাহিমই নির্ধারণ করবেন!
মেয়েটি কিছুতেই মানছে না। পাপের অনুশোচনায় সে এমনভাবে দগ্ধ হয়েছে, আল্লাহর শাস্তির ভয়াবহ আঁচ তার অন্তকরণ এমনভাবে ঝলসে দিয়েছে, পরকালের কঠিন শাস্তির চেয়ে দুনিয়ার শাস্তি তার কাছে তুচ্ছ বলে মনে হচ্ছে।
আল্লাহর রাসুলের সামনে কাতরকণ্ঠে বলতে লাগলো, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি জানি এ পাপের শাস্তি কতো ভয়াবহ! পাথর ছুঁড়ে মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু তারপরও সেই শাস্তি স্বেচ্ছায় বরণ করে নিতে আমি প্রস্তুত আছি। দুনিয়ার এই সামান্য শাস্তির চেয়ে আখেরাতের শাস্তি অনেক ভয়াবহ, সীমাহীন যন্ত্রণাদায়ক। তাই দয়া করে আপনি দুনিয়ার শাস্তি কার্যকর করে আখেরাতের অসহনীয় শাস্তি থেকে আমাকে পরিত্রাণের ব্যবস্থা করে দিন। নইলে আমি সারাটি জীবন এক দুঃসহ যাতনা বয়ে বেড়াবো। অনুশোচনার অনুতাপ আমাকে পলেপলে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। আখেরাতে আল্লাহর সামনে আমি আপনার সুপারিশ নিয়ে দাঁড়াতে চাই।
মেয়েটির অস্বাভাবিক কাতর অনুনয়, তার অনুতাপের প্রত্যয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ব্যথিত করলো। তিনি ব্যথা ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে কঠোর হলেন। মেয়েটিকে বললেন, তুমি এই ভরমজলিসে স্বেচ্ছায় তোমার অপরাধের কথা বারবার স্বীকার করেছো। তাই তোমার উপর শাস্তি কার্যকর করা যেতে পারে। কিন্তু যেহেতু তুমি এখন গর্ভবতী, তাই তোমার মৃত্যুদণ্ড এই মুহূর্তে কার্যকর করা যাবে না। কারণ, তুমি দোষী হলেও তোমার গর্ভের সন্তান দোষী নয়। সে নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ ও পবিত্র। তোমার কারণে তার প্রাণদণ্ড হতে পারে না।মেয়ে, তুমি এখন চলে যাও। তোমার সন্তান জন্ম নেয়ার পর তুমি আবার এসো। তখন তোমার শাস্তির ব্যাপারে ফয়সালা করা হবে।
মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো। আহ্! অনুশোচনা!!
নয় মাস পর।
মদিনায় একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হলো। আর দশটা সাধারণ শিশুর মতোই জন্মের পর সে তীব্র চিৎকার করে ঘোষণা দিলো তার পৃথিবীতে আগমনের সংবাদ। কচি হাত-পা নেড়ে অন্যসব নবজাতকের মতোই সে জানান দিলো, তার ক্ষুধা পেয়েছে। কিন্তু শিশুটি জানে না, তার মা একজন ব্যভিচারিণী। সে ব্যভিচারের ফসল। তার মায়ের মাথার ওপর ঝুলছে পাথরছোঁড়া মৃত্যুদণ্ড!
শিশুটি এসবের কিছুই জানে না। শিশুদের সবকিছু জানতে নেই। শিশুদের সবকিছু জানাতে নেই। তারা বেহেশতি ফুলের মতো পবিত্রতা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে, তাদেরকে পবিত্র রাখতে হয়।
জন্মদাত্রী মা সন্তান জন্ম দিয়ে একবার আকুল নয়নে তাকালো নাড়ীছেঁড়া সন্তানের দিকে। অনেকটা সময় নিয়ে দেখলো। চোখজুড়ানো কমলকান্তি মুখাবয়ব। দু’হাত বাড়িয়ে দিলো কোলে নেয়ার জন্য। পরক্ষনেই গুটিয়ে নিলো হাত।
না, এই পাপহাতে সে ছোঁবে না তার পবিত্র শিশুকে। তার পাপের কালিমা সে লাগাবে না তার সন্তানের শরীরে। মদিনার পুণ্য আলো-বাতাসে সে বড় হোক পুণ্যমানুষের সান্নিধ্যে। তার পাপী স্পর্শ যেনো কোনো প্রভাব না ফেলে তার সন্তানের দেহ-মনে।
জন্মদাত্রী কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এলো আঁতুড়ঘর থেকে। মদিনার অলিগলি পার হয়ে পৌঁছলো রাসুলের আঙিনায়। বুকের মধ্যে কান্না আটকে ডাকলেন— ইয়া রাসুলাল্লাহ! পাপিষ্ঠা হাজির! ব্যভিচারিণী উপস্থিত আপনার চরণতলে। আমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। এখন আমি গর্ভ থেকে মুক্ত। আমার ওপর প্রয়োগ করুন শরিয়তের শাস্তি। শাস্তি দিয়ে পবিত্র করুন আমাকে ও আমার সন্তানকে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তার সামনে এলেন। বেদনায় মোচড় দিয়ে উঠলো ভেতরটা। জন্মদাত্রী মাকে প্রবোধ দিলেন, সান্ত্বনা দিলেন। তাকে শান্ত হতে বললেন।
মেয়েটি শান্ত হলে তিনি তাকে বললেন, মেয়ে, যাকে তুমি জন্ম দিয়েছো সে তোমার সন্তান। তোমার গর্ভে তার জন্ম। তোমার গর্ভের কোনো পাপ নেই। তোমার সন্তানেরও কোনো পাপ নেই। যাও, ফিরে যাও। তাকে ভালোভাবে লালন-পালন করতে থাকো। তাকে দুধপান করাও। তোমার বুকের দুধে সে বেড়ে উঠুক। তোমার বুকের দুধে কোনো পাপ নেই। সে যখন দুধপান করা ছেড়ে দিয়ে অন্য খাবার গ্রহণ করতে শিখবে, তার জীবনধারণ করার ক্ষেত্রে তোমার উপর নির্ভরশীল থাকবে না, নিজে নিজে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারবে, তখন তুমি আসবে। আর আমি তোমার উপর শরিয়তের বিধান কার্যকর করবো, শাস্তি প্রদান করবো।
মেয়েটি আবার আশায় বুক বাঁধলো। আবার আশাহত হলো। অনুতাপের আগুনে তাকে আবার পুড়তে হবে কতো রাত, কতো দিন- কে জানে!
বাড়ি ফিরে এলো সে। ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো তার দুগ্ধপোষ্য সন্তান। বুকে আগলে রাখেন তাকে। মাঝে মাঝে ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন মোলায়েম শরীরের শিশুটির দিকে। মায়ের দিকে তাকিয়ে খলবলিয়ে হেসে উঠে সে। যেনো চেষ্টা করে মায়ের চেহারার বিষাদ দূর করতে। মায়ের মুখের বিষাদ তবু সরে না।
***
দিন যায়। মাস যায়।
জন্মদাত্রী মা সন্তানকে দুধপান ছাড়িয়ে অন্যান্য খাবারের দিকে মনোনিবেশ করে। আস্তে আস্তে সে মাকে ছাড়াই এটা-সেটা খেতে শুরু করে। খাওয়ার জন্য নিজের চাহিদা মাকে জানাতে শেখে।
ততোদিনে সব ধরনের আবেগ-অনুরাগ চলে যাওয়ার কথা মায়ের। হুঁশে ফিরে স্বাভাবিক জীবনের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার কথা, জীবনের উপর মমতা জন্ম হওয়ার কথা। কিন্তু না, আখেরাতের ভয়ে সে তখনও ভীত, কোনো পরিবর্তন নেই। সন্তান প্রসবের আড়াই বছর পর যেখানে সন্তানের স্নেহমায়ায় নিজেকে আরও জড়িয়ে নেওয়ার কথা, তার ভালোবাসায় ডুবে যাওয়ার কথা। যেখানে আদালতে তার অপরাধের কোনো মামলা নেই, নথিপত্র নেই; নেই কোনো তথ্য-প্রমাণ, কোনো সাক্ষী, একটু চাইলেই নিজেকে বাঁচিয়ে নেয়ার সমস্ত উপকরণ বিদ্যমান, সেখানে একমাত্র আখেরাতের শাস্তির ভয়ে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ও জীবনদানে প্রস্তুত সে। উদগ্রীব দুনিয়ার শাস্তি বরণ করে আখেরাতের মুক্তির জন্য।
আড়াই বছর পর।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম-এর দরোজায় আবার এক সকালে কড়া নড়ে উঠলো— ব্যভিচারিণী হাজির! তাকে শরিয়ত মোতাবেক পাথরছোঁড়া শাস্তি দিন হে আল্লাহর রাসুল!
কোলে আড়াই বছরের নিষ্পাপ শিশু তার। শিশুর মুখে রুটির টুকরো, যাতে উপস্থিত সকলে বুঝতে পারে- তার সন্তান আর তার বুকের দুধের উপর নির্ভরশীল নয়। সে এখন অন্য খাবার খেয়ে জীবন ধারণ করতে সক্ষম। সে না থাকলেও তার কোনো সমস্যা হবে না।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আবার সবিনয় নিবেদন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনার সঙ্গে প্রতিশ্রুত অঙ্গীকার অনুযায়ী আমি এসে উপস্থিত হয়েছি। সকল শর্ত পূর্ণ হয়ে গেছে। শরিয়তের বিধান কার্যকর করতে এখন আর কোনো বাধা নেই। তাই দয়া করে দ্রুত আমাকে পবিত্র করুন। দুনিয়ার সামান্য শাস্তির বিনিময়ে আখেরাতের অফুরন্ত শাস্তি থেকে আমাকে রক্ষা করুন।
মদিনার বাতাস কি স্তব্ধ ছিলো কিছুক্ষণের জন্য? মদিনার নরোম দিলের লোকদের চোখগুলো কি আজ একটু বেশি কেঁদেছে? মদিনার খর্জুরবীথিকা-বনে আজ সবুজেরা কেমন নিষ্প্রভ! কোথায় সেই আড়াই বছরের শিশুসন্তানটি, আম্মি আম্মি বলে যে ডাকতো তার মাকে?
অবশেষে রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম শরিয়তের বিধান কার্যকর করার নির্দেশ দিলেন এবং পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলো সেই সে পাপিষ্ঠা মেয়েটির। ইতিহাস যার নাম বলেনি অনাগত পৃথিবীর কাছে।
***
মেয়েটির জানাজা সমাগত। মদিনার নবি, আমার রাসুল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং তার জানাজা নামাজ পড়ানোর জন্য সামনে অগ্রসর হলেন। তার দু’চোখ অশ্রুর জলে টলটলায়মান। তিনি আজ ইমাম। নামাজ পড়াবেন এক ব্যভিচারিণীর।
হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর চোখও ভেজা। হাত ধরে ফেললেন আল্লাহর রাসুলের। জিজ্ঞেস করলেন— মুর্শিদ আমার, এ মেয়ে ব্যভিচারিণী। অথচ আপনি নিজে তার জানাজা নামাজ পড়াতে যাচ্ছেন! আমায় বলুন রহস্যের অন্যূন উচ্চারণ!
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বড় বেদনা নিয়ে তাকালেন ওমরের দিকে। দ্বিধাহীনকণ্ঠে বললেন, হে ওমর, মেয়েটি ব্যভিচারিণী। সে পাপিষ্ঠা। গর্হিত তার অপরাধ। কিন্তু সে এমন আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে তওবা করেছে যে, যদি সেই তওবার দশ ভাগের এক ভাগও গোটা মদিনাবাসীর মাঝে বণ্টন করে দেয়া হতো, তাহলে সমস্ত মদিনাবসীর গোনাহ মাফ হয়ে যেতো।
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এগিয়ে গেলেন সামনে। উচ্চকণ্ঠে তাকবির দিলেন— আল্লাহু আকবার! তার উচ্চারণের সঙ্গে সমস্ত মদিনাবাসী উচ্চারণ করলো— আল্লাহু আকবার! আল্লাহুম্মাগফির লি হায়্যিনা ওয়া মায়্যিতিনা...।
0 Comments