সন্ধ্যার পূর্বেই কাজ সেরে শহর দিকে রওয়ানা হলাম। পথে দেখা হয়ে গেল  সুহাইব ভাইয়ের সাথে। সুহাইব ভাই সদালাপি এক তরুণ আলেম। শহরেই তাঁর সাথে পরিচয়।

সালাম-মোসাফাহা শেষে
উনি বাসায় নিয়ে গেলেন।
আবছা আঁধার তখন নেমে গেছে পুরো গ্রাম জুড়ে। কৃষকেরা কাজ শেষে  ফিরছে ঘরে।পাখিরা ফিরছে আপন নীড়ে।

সুহাইব ভাই আমাকে তাঁর রুমে বসিয়ে ভেতরে গেলেন। আমি সোফায় বসে ভাবছি কখন শহরে ফিরবো। অজানা এক ভীতি কাজ করছিল মনের মধ্যে। মিনিট পাঁচেক পর চা'র ট্রে হাতে রুমে প্রবেশ করলেন তিনি। দুজনে চা'র কাপে চুমুক দিতে দিতে গল্প করছিলাম। কিছুক্ষণের মাঝেই মিনার থেকে ভেসে এলো "আল্লাহু আকবারের" সুমধুর ধ্বনি।

সুহহাইব ভাইদের বাড়ি থেকে গ্রামের বড় মসজিদটা অনেক দূরে। তাই বাড়ির মধ্যেই আছে পাঞ্জেগানা মসজিদ। গ্রামে এমন মসজিদের প্রচলন থাকলেও শহরে খুব একটা নজরে পড়েনা। গ্রামের পুকুরে খুব স্বাচ্ছন্দ্যে অযু করে, সালাতে মাগরিব আদায় করলাম ঐ মসজিদে।




আজ বাদ আসর গ্রামের মাদরাসায় খতমে বোখারীর দো'আ অনুষ্ঠান ছিল। তাশরীফ এনেছিলেন মাদানী সাহেব। শহরের অনেক বড় বড় হুজুররাও এসেছিলেন। বস্তুত একারণেই গ্রামে এসেছিলাম।
গ্রামের মাদরাসার বড় হুজুরের ভাতিজা সুহাইব ভাই। সূর্যাস্তের পূর্বে মাদানী সাহেব চলে গেলেও। অন্যান্য হুজুররা তাশরীফ আনেন বড় হুজুরের বাড়িতে। নামাযের পর কিছুক্ষণ তাঁদের সংস্পর্শে বসে নিজের পাপের বোঝা যেন একটু হালকা হলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবলাম আর বসলে হবেনা। এবার ফিরতে হবে। পুনশ্চঃ সুহাইব ভাই ছাড়া কেউই চেনেনা আমাকে। কিন্তু আমি এ গাঁয়ের'ই ছেলে। বাড়িতে অনেক মেহমান, সুহাইব ভাই খুবই ব্যস্ত।  বিদায় নেয়ার জন্য উনাকে খুঁজছি কিন্তু পাচ্ছিনা। বাধ্য হয়ে বিদায় না নিয়েই আসতে হলো। 



তখন আঁধারে ছেয়ে গেছে পুরো গ্রাম।
অদৃশ্য থেকে শুনা যাচ্ছে শিয়ালের আওয়াজ। কোথাও আলোর দেখা নেই।
বিদঘুটে অন্ধকার। যেন অমাবস্যা রাত। আলোর মত অকাল ছিল মানুষেরও। রাস্তা একদম নীরব, নিস্তব্ধ। মনে হচ্ছিল অনেক রাত হয়ে গেছে।গ্রামের বাজার অনেক দূর। রিক্সা কিংবা অন্য কোন বাহন দেখছিনা। বুঝলাম অমাবস্যা রাতের এই অন্ধকারে হেঁটেই বাজারে যেতে হবে। ভয়ে ভয়ে হাঁটছি। সামান্য হাঁটতেই গলা শুকিয়ে চৌঁচির। তবু থেমে নেই হাঁটছি খুব দ্রুত বেগে। পথ যেন ফুরাচ্ছে না। কাঁটছে না অন্ধকারও। দুপাশে ঘন গাছপালা ।  সামনের দিকটাতে কেবল অন্ধকারই দেখছি। হঠাৎ কেন যেন পেছনে তাকিয়ে ছিলাম। মাথাটা পেছনে দিকে ঘুরাতেই শিওরে উঠলাম। হার্টবির্ট বেড়ে যেন একদম শেষের কোটায় এসে পড়েছে। ভয়ে শরীর থেকে ঘাম বেয়ে পড়ছে। দেখলাম পেছনে সফেদ পোশাক পরিহিত কে যেন আসছে। ভয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছিল। ভয়ে নির্বাক নির্বোধ হয়ে পড়ছিলাম। পাঞ্জাবির পকেটে তখন ঝুলছে পাঁচ ইঞ্চি সাইজের সিম্ফনি মোবাইলটি, সেটি বের করে টচ লাইট জ্বাললে কিছু আলো পাওয়া যেত, সেই সহজ কাজটিও যেন ভয়ে ভুলে গিয়েছিলাম।






হঠাৎ পেছন থেকে আলোর দেখা। হেড লাইট জ্বালিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে একটি সিএনজি। পেছনে তাকিয়ে গাড়িটিকে সিগনাল দেওয়ার সাহসটা হারিয়ে ফেলেছি পূর্বের সফেদ পোশাক পরিহিত লোকটার কথা ভেবে। গাড়িকে সিগনাল না দিয়েও পারছিনা। তাই সামনের দিকে হেঁটে হেঁটে হাত উঁচু করে গাড়িকে থামতে ইশারা করলাম। আলোর দেখা পেলেও ভয় কাঁটেনি তখনও। শরীর তখনও ভয়ে কাঁপছে। ভাঙা গলায়  সিলেটী টোনে  চালককে বললাম "লইয়্যা যাও বা" বলে উঠে পড়লাম। চালক হ্যাঁ না কিছুই বলেনি। গাড়ি একদম ফাঁকা। চালক নীরব মনে ড্রাইভ করছে। তার এই নীরবতা আমাকে যেন আরো অস্থির করে তুলছে। মনে মনে শুধু দো'আ, দুরূদ পাঠ করছি আর ভাবছি খোদাই জানে আজ কি হবে আমার ভাবতে ভাবতে চলে এলাম বাজারে,থেমে গেল গাড়ি। গাড়িচালক লোকটা তখনও কথা বলেনি। ভয়ে কথা বলিনি আমিও। গাড়ি থেকে নেমে কিছু জিজ্ঞেস না করে ২০টাকার একটি পুরাতন নোট তার হাত ধরিয়ে দিয়ে সোজা পথে হাঁটতে থাকলাম। লোকটিও কিছু বলল না যে, ভাড়া কম হয়েছে অথবা বেশী।

বাজারের একটি মুদি দোকানে ঢুকে এক লিটার পানি নিলাম। গলা ভিজিয়ে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। অবশিষ্ট পানির কিছু অংশ টুপি খুলে মাথায় আর কিছু পাঞ্জাবীর ভেতরে ঢেলে মাথা ও শরীর ঠান্ডা করলাম। অতঃপর বাজার থেকে বাসে উঠে শহরের ফিরলাম।

সফেদ পোশাক পরিহিত লোকটা আর সিএনজি চালক উভয়কে নিয়ে কৌতূহল কাঁটেনি আজও। তারা কি আদৌ মানুষ ছিল নাকি......। ভাবতেই শিওরে উঠি।