ভাষা-আন্দোলন ও হুজুগে বাঙাল।

আবুল কাসেম আদিল

ভাষা-আন্দোলন বাঙালির ইতিহাসে গৌরবজনক অধ্যায়গুলোর অন্যতম। নিজেদের মাতৃভাষার মান সমুন্নত রাখার জন্য যে জাতি প্রাণবিসর্জন দিতেও কুণ্ঠিত হয় নি, সে আমরাই — আমরা বাঙালিরাই। বাঙালির ভাষার জন্য আত্মত্যাগের এই ইতিহাস যুগ যুগ ধরে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
 এই আত্মবিসর্জনের ইতিহাসই বাঙালির গর্বের জন্য যথেষ্ট। গৌরববৃদ্ধির জন্য ইতিহাসের বিকৃতি বা অতিরঞ্জনের দরকার নেই। দুঃখজনক হলো তবু ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে বিকৃতি বা অতিরঞ্জন হচ্ছে। বাঙালি বিনা প্রয়োজনে নিজের ঘাড়ে ইতিহাসবিকৃতির কলঙ্ক বহন করতে প্রবৃত্ত হয়েছে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ছবিঃ মুহাম্মদ রায়হান।


ইতিহাস অনুসন্ধানে একথা প্রতীয়মান হয় যে, ‘৫২র ভাষা-আন্দোলন বিশেষ কোনো ভাষার বিপক্ষে ছিল না; ছিল একটি ভাষার পক্ষে। ইতিহাস এটাই বলে যে, আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল যেন উর্দুর ‘পাশাপাশি’ বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয়া হয়। একমাত্র বাংলা ভাষা হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, সেসময়কার প্রেক্ষাপটে এমন দাবি জানানো হয় নি। আর এই না জানানোই ছিল যৌক্তিক।
কিন্তু দুঃখজনক হলো, উগ্র জাতীয়তাবাদীরা ভাষা-আন্দোলনের খণ্ডিত ইতিহাসের চর্চা করছে। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ‘৫২কে বিশেষ একটি ভাষাবিরোধী আন্দোলন হিসেবে উপস্থাপন করেছে এবং করছে। আর নবপ্রজন্মও এমন, এদের মধ্যে চিলে কান নিয়েছে শুনে কানে হাত দিয়ে সত্যতা যাচাইয়ের গরজ বোধকারীদের সংখ্যা খুবই কম; চিলের পিছে দৌড় লাগানেওয়ালাদের সংখ্যাই বেশি।
ইতিহাসের আলোকে ‘উর্দুর পাশাপাশি’ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা স্বীকৃতির আন্দোলন: নভেম্বর ১৯৪৭। পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগে পশ্চিম পাকিস্তানে আয়োজিত “পাকিস্তান এডুকেশনাল কনফারেন্সে” পূর্ব – পাকিস্তান হতে আগত প্রতিনিধিরা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন এবং ‘বাংলাকেও সম-অধিকার’ প্রদানের দাবি জানান।  [দৈনিক আজাদ, কলকাতা, ৮ই নভেম্বর, ১৯৪৭]
জুলাই – ডিসেম্বর ১৯৫১। এই সময়ে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল আব্দুল মতিনের নেতৃত্বাধীন “দ্যা ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্ট্যাট ল্যাঙ্গুয়েজ মু্ভমেন্ট কমিটি”। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলাই, সেপ্টেম্বর, অক্টোবরে পৃথক পৃথক সমাবেশ করে বাংলাকে ‘উর্দুর পাশাপাশি’ রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার দাবি জানানো হয়। এই সময়ের সমাবেশগুলোতে কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, গাজীউল হক প্রমুখ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ভাষা-আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এই প্রস্তাবে কিছু সংশোধনের প্রস্তাব করে বাংলাকে পাকিস্তানের ‘অন্যতম’ রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে একটি সংশোধনী প্রস্তাব করেন। [Minority Politics in Bangladesh (1947-’71)]
৯ই মার্চ ১৯৪৯। পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাকে সরকারি কর্মকাণ্ড ও শিক্ষার একমাত্র ভাষা এবং সেই সঙ্গে ‘উর্দুর পাশাপাশি’ রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার অব্যাহত আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে খাজা নাজিমুদ্দিনের উদ্যোগে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে আরবি হরফে প্রচলন করার ব্যাপারে একটি প্রস্তাব দেয়া হয়। [DEFINING THE FRONTIERS OF IDENTITY: BALANCING LANGUAGE AND RELIGION IN BANGLADESH]
১৪ই নভেম্বর ১৯৫০। পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবিদের সমন্বয়ে গঠিত “কমিটি অফ অ্যাকশন ফর ডেমোক্র্যাটিক ফেডারেশন” ১৪ই নভেম্বর ১৯৫০ ঢাকায় আয়োজন করে “গ্র্যান্ড ন্যাশনাল কনভেনশন”। সেই কনভেনশন থেকে বাঙালিদের মুল দাবিগুলোর সঙ্গে ‘উর্দুর পাশাপাশি’ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। [Constitutional Development, Banglapedia, 1773-1972]
১১ই মার্চ ১৯৫১। “দ্যা ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্ট্যাট ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্ট কমিটি” পূর্ব বাংলার সকল পত্র-পত্রিকায় এবং গণপরিষদের সদস্যদের মধ্যে বাংলাকে ‘উর্দুর পাশাপাশি’ রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবিতে একটি স্মারকলিপি পাঠায় । [Martyr Dhirendranath Datta My tribute to the forgotten Harbinger of the Bengali language movement]
লক্ষণীয় যে, সবগুলো উদ্ধৃতিতেই উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতির দাবি জানানো হয়েছে বলে উল্লেখ আছে। যেসব স্থানে ‘পাশাপাশি’ কথাটা উল্লেখ নেই, সেসব স্থানেও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা মানতে আপত্তি জানানো হয় নি। বরং কখনওই বাংলাকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয় নি।


এটা সত্য যে, একাত্তরের স্বাধীনতালাভের পর এ অঞ্চলে উর্দুর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। ফলে এখন বাংলাই এদেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে, এটাই যৌক্তিক। তাই বলে উর্দু বা অন্য কোনো ভাষার প্রতি ঘৃণাপ্রকাশ গ্রহণযোগ্য নয়। বরং ভাষার প্রতি ঘৃণাপ্রকাশ— তা যে ভাষাই হোক, ঘৃণ্যকর্ম।
  • উর্দু অথবা হিন্দি, আরবী অথবা ফার্সি, ইংরেজি অথবা তুর্কি— কোনো ভাষার বিরুদ্ধাচরণই সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ কোনো ভাষাই মনুষ্যসৃষ্ট নয়। সব ভাষাই মহামহিম আল্লাহর নিদর্শন। আমার ভাষা যেমন আমার কাছে অতিপ্রিয়, আমি যে ভাষাটির চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করা পূণ্যকর্ম মনে করছি, সেটাও কিন্তু কোনো এক মানবজাতির প্রিয় ভাষা। আমি মানুষ হয়ে মানুষের ভাষাকে অশ্রদ্ধা করি কীভাবে! 
আপাতদৃষ্টিতে কোনো ভাষা যদি খারাপও মনে হয়, তা ভাষীর কারণে। উদাহরণ হিসেবে বাংলাভাষার কথাই উল্লেখ করা যেতে পারে। এই ভাষা বাংলাদেশে এসে এখানকার অধিবাসীদের সংস্কৃতি ধারন করেছে, লালন করছে এখানকার অধিবাসীদের চিন্তা-চেতনা। এই ভাষাই পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে সেখানকার অধিবাসীদের সংস্কৃতি ধারণ করেছে, লালন করছে সেখানকার অধিবাসীদের চিন্তা-চেতনা। তদ্রুপ আরবীভাষায় ইসলামপূর্ব জাহিলিয়াতের যুগে তৎকালীন কলুষিত আরব্যসংস্কৃতি প্রতিবিম্বিত হয়েছে। ইসলামের আগমণের পর ধারণ করেছে ইসলামের নির্মল সংস্কৃতি। 
এর পরও যদি কারো মনে হয় এই মহাবিশ্বে একমাত্র বাংলাভাষাই কথনযোগ্য ও শ্রবণযোগ্য ভাষা, তাহলে বাংলাভাষার গা থেকে আরবী, ফার্সি, হিন্দি, ইংরেজির অলঙ্কারগুলো খুলে ফেলুন। দেখুন, আমার-আপনার প্রাণের ভাষাটিকে কেমন মলিন, বিবর্ণ ও বৈচিত্র‍্যহীন মনে হয়! এর মানে এই নয় যে, বাংলাভাষায় জোর করে অন্য ভাষার শব্দ ঢোকাতে হবে, যেমন কেউ কেউ চেষ্টা করছেন। যা ঢুকবারযোগ্য আপসে আপই ঢুকবে। 
সাধারণভাবে যে কোনো ভাষা সম্মানের চোখে দেখলেও নিজ ভাষার মৌলিকত্ব রক্ষায় অধিক যত্নবান হওয়া উচিত। নিজ ভাষায় অন্য ভাষার অহেতুক ব্যবহার পরিহার করতে হবে। নয়ত নিজ ভাষা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্য ভাষার গায়ে সওয়ার হয়ে সে ভাষাভাষীদের সংস্কৃতি যাতে কোনোক্রমে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সেদিকে সর্বোচ্চ সতর্ক দৃষ্টি রাখার প্রয়োজন রয়েছে।
═══════════════

Post a Comment

0 Comments