মীম সুফিয়ান।

স্বীকৃতি নিয়ে আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে, আদৌ স্বীকৃতির ঘোষণা বাস্তবায়িত হবে কি না, হলে সেটা আমাদের চাহিদা, শর্তাবলী ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির আলোকে হবে কি না, সরকারের এই আমলেই কি হবে, নাকি নির্বাচনের বন্যায় ভেসে গিয়ে বিলম্বিত হবে- আদৌ তা আমরা কেউ জানি না। তবে কয়েকজন অনলাইন এক্টিভিটিস্টের পোস্ট এবং দুয়েকটি অনলাইন নিউজপোর্টালের প্রতিবেদন থেকে আমরা যা বুঝতে পারছি, তা হলো, 'সরকার চাচ্ছে তাদের খুশিমতো কওমী মাদরাসার স্বকীয়তা নষ্ট করে স্বীকৃতি দিতে এবং হাইআতুল উলইয়ার কর্ণধার বুজুর্গরা চেষ্টা করছেন, সেই ষড়যন্ত্রকে বাস্তবায়ন করে কওমী মাদরাসার স্বকীয়তাকে জলে ভাসিয়ে দিতে।'
তারা এ নিয়ে কয়েকটি পয়েন্ট চিহ্নিত করে প্রশ্ন সৃষ্টির ও অভিযোগ উত্থাপনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

আমি এসব সমকালীন ও বিতর্কিত বিষয় নিয়ে মন্তব্যমূলক বক্তব্য ফেবুতে খুব কমই নিয়ে আসি। কিন্তু ক্লিন ইমেজ্ড (এখন পর্যন্ত) বুজুরর্গদের মানহানি এবং কওমী মাদরাসার সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী টেবিল আল হাইআতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কাওমিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ ও হেয় করার প্রয়াস যখন চালানো হচ্ছে, তখন এর বাস্তবতা জেনে কিছু বলা এবং কওমীপ্রেমীদের সামনে বিষয়গুলো খোলাসা করে প্রজন্মকে বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করা কর্তব্য মনে করছি। এই তাড়না থেকেই লেখাটির জন্ম।
যারা অভিযোগ তুলে হাইআ ও তৎসংশ্লিষ্ট বুজুর্গদেরকে কলুষিত করতে চাচ্ছেন, তারা হাইআর নীতিনির্ধারকদের সাথে যোগাযোগ না করেই এসব অপপ্রচারে নিরত হয়েছেন। এদের অপপ্রচারে ব্যথিত হয়ে হাইআর কয়েকজন দায়িত্বশীলের সাথে যোগাযোগ করতে আমি ব্যক্তিগতভাবে সমর্থ হই। তাঁদের বক্তব্যের আলোকেই আমার এই মন্তব্য প্রতিবেদন।
চেষ্টা করবো, একে একে তাদের উত্থাপিত অভিযোগগুলো খণ্ডন করবার ও বিভ্রান্তি অপনোদন করবার।

এক. তাঁদের অভিযোগ, 'শিক্ষা কারিকুলাম তৈরির জন্য ইউজিসি কমিটি কেন? এটা আবার কী? এই কমিটি ও তার বাইরের সদস্যদের মাঝে কোনো আলেম নেই কেন? ইফা ডিজি সামিম আফজাল এতে সম্পৃক্ত হলেন কীভাবে?'
আসলে আমরা 'চিলে কান নিলো' শুনলেই চিলের পেছনে দৌঁড়াতে পছন্দ করা জাতি। বাস্তবতা খোঁজার চেষ্টা করি না।
আসুন জেনে নিই বাস্তবতা, আলোচিত ৯ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়ার একটি অংশ। এটা রেজুলেটেড ও স্থায়ী কোনো কমিটি নয়। শিক্ষা কারিকুলাম তৈরি করে দিয়েছে হাইআ। ইউজিসির ৬জনসহ ৯ জনের এ কমিটিকে হাইআর কারিকুলাম ও গঠনতন্ত্র পর্যবেক্ষণ করে মতামত দেবার এবং সংশ্লিষ্ট আইনি কাঠামো প্রণয়ন করবার জন্য গঠন করা হয়েছে। শিক্ষা কারিকুলাম তৈরি করবার জন্য এ কমিটি নয় -যেমনটি প্রচার করা হচ্ছে।
কাকে কমিটিতে রাখা হলো কাকে রাখা হলোনা- এই প্রশ্ন এখানে অবান্তর। সরকার তার অধীনস্ত কর্মকর্তাদেরকেই এখানে রেখেছে, বাইরের বাউকে নয়। আরো লক্ষ করলে আমরা দেখবো, সেখানে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাব্যবস্থার পর্যবেক্ষকদের পাশাপাশি রাখা হয়েছে, ৩ গুরুত্বপূর্ণ ইসলামি প্রতিষ্ঠান-প্রধানকে। তারই অংশ হিসেবে হয় তো সামীম আফজালকে রাখা হয়েছে কমিটিতে। যেহেতু সরকারের অভ্যন্তরীন প্রক্রিয়ার জন্য এ কমিটি, সেখানে সরকার তার লোকই রাখবে, এটাই স্বাভাবিক বিবেচ্য বিষয়। (অভিযোগকারীদের বক্তব্য অনুসারে) এ কমিটি যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা রাখেও, তথাপি হাইআ সেটা মানতেই হবে তেমন তো কথা নয়। তবে এ ভ্রম সৃষ্টির অপচেষ্টা কেন?

দুই. অভিযোগ তোলা হচ্ছে, 'ইউজিসি হলো উচ্চশিক্ষা নিয়ন্ত্রক একটি কমিটি। সেটা নিয়ে নিচ্ছে কওমী শিক্ষা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব।'

ইউজিসিকে এ দায়িত্ব দিলো কে? ইউজিসি তো পর্যবেক্ষণের জন্য সাময়িকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। আর ইউজিসি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও সেটা আমাদের নেতৃবৃন্দ মেনে নেবেন বলে কি কোনো আভাস এসেছে?

তিন. বেফাক মহাসচিব, হাইআর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল শাইখুল হাদীস আল্লামা আব্দুল কুদ্দুস সাহেবের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে একটি ব্যক্তিগত বৈঠককে ষড়যন্ত্র আখ্যা দিতে চাচ্ছেন অপপ্রচারকারীরা। জানেন না? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বলেছেন, কোনো ব্যক্তি মিথ্যুক হওয়ার জন্য ইহাই যথেষ্ঠ যে, সে যা শোনে, তা বলে বেড়ায়। বেফাক মহাসচিবের রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণের জন্য সরকারি সহযোগিতা পেতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে হয়ে যাওয়া এ সাক্ষাৎকে কেন ভিন্ন প্রবাহে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে? এটা কি তুহমতের শামিল নয়?

চার. বিতর্কিত ব্যক্তি সামীম আফজালের সাথে বৈঠক নিয়েও ছড়ানো হচ্ছে বিভ্রান্তি। বলা হচ্ছে, সে বৈঠক ছিলো গোপনে ও মাওলানা আব্দুল কুদ্দুসের একক সিদ্ধান্তের বৈঠক। চেপে রাখা হচ্ছে  হাইআর কো-চেয়ারম্যান, বরেণ্য ও অবিসংবাদিত প্রাজ্ঞ বুজুর্গ আলিম শাইখুল হাদীস আল্লামা আশরাফ আলী সাহেবের সে বৈঠকে অংশগ্রহণের কথা।

আসলে কেন ছিলো সেই বৈঠক? কী ছিলো সে বৈঠকে? সেখানে ছিলেন কারা?
ইফাবা ডিজি সামীম আফজালের কাছে সরকারের কাছ থেকে চিঠি এলো ইউজিসির মিটিংয়ে যাবার জন্য। চিঠি পেয়ে সামীম আফজাল উদ্যোগী হলেন স্বীকৃতির স্বরূপ, কওমী মাদরাসা ও হাইআর চাহিদা এবং এতদসংক্রান্ত সার্বিক বিষয়ে জানতে ও বুঝতে। তাই সে চিঠিসহ একজন লোক তিনি পাঠিয়ে দিলেন ফরিদাবাদে মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস সাহেবের কাছে। তিনি ডিজির দূতকে বলে দিলেন, কো-চেয়ারম্যান আল্লামা আশরাফ আলী সাহেবের সাথে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করতে। ঐ লোক তখন আশরাফ আলী সাহেবের কাছে গিয়ে সামীম আফজালের সাক্ষাতের আগ্রহ ও আমন্ত্রণ পেশ করলে আল্লামা আশরাফ আলী মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস ও মুফতি নূরুল আমীনকে নিয়ে ইফাবা ডিজির সাথে সাক্ষাতে মিলিত হন। এটা ছিলো না কোনো গোপন বৈঠক।
সচেতনজন মানেই বুঝতে অসুবিধা হবার কথা না যে, অবশ্যই স্বীকৃতি উদ্ধারের পথে এ বৈঠকের রয়েছে সহায়ক অবদান। এখানে আশরাফ আলী সাহেবের নাম (জনসমর্থন হারানোর ভয়ে) গোপন করা এবং হাদীসের বরেণ্য খাদেম, আল্লামা আহমদ শফীর আস্থাভাজন ও ১ম সারির খলিফা, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মাদরাসা ফরিদাবাদের মুহতামিম ও শাইখুল হাদীস, অজস্র কওমী-আলিমের শ্রদ্ধাভাজন শায়খ ও উস্তাদ, বেফাকের মহাসচিব মাওলানা আব্দুল কুদ্দুসকে এই বৈঠকের জন্য ষড়যন্ত্রের অপবাদ দেয়া এবং বৈঠকের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে হেয় ও অপদস্ত করার অপপ্রয়াস চালানো কতোটা নীচতার পরিচায়ক, তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়।

পাঁচ. কেরানিগঞ্জের ৩ একর জায়গা নিয়েও ধূম্রজাল সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছে। বলা হচ্ছে তা উসূলে হাশতেগানা বিরোধী। আসলে বিষয়টি কী?
প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব ব্যক্তিগতভাবে চেয়েছেন হাইআকে ৩ একর জমি অনুদান হিসেবে দিতে। হাইআ এখনো সেটা নেয় নি। তারা বিষয়টি বিবেচনাধীন রেখে মূল্যের বিনিময়ে বরাদ্দ নেবার মনস্ত করেছে। উসুলে হাশতেগানায় মূল্য দিয়ে বরাদ্দ নেয়া যাবে না বলে কোনো ধারায় উল্লেখ নেই। সরকারি অংশগ্রহণ ও অনুদান না নেয়ার কথা রয়েছে। এখানে বরাদ্দ দিলে সরকারের অংশগ্রহণ বা অনুদান থাকলো কী করে? দেশে প্রচুর কওমী মাদরাসা এমন আছে, যেগুলো খাস জমি বা বরাদ্দ নেয়া জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। মাদরাসাগুলো জমি এই প্রক্রিয়ায় নিলে অসুবিধা না হলে হাইআ নিতে সমস্যা কোথায়?




পরিশেষে কথা হচ্ছে, স্বীকৃতি আদৌ সরকার দেবে কি না, দিলে কোন রূপরেখার আলোকে দেবে, এতে কওমীর চাহিদার ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন ঘটবে কি না- তা আমরা কেউই স্পষ্টভাবে জানি না। তবে হাইআর নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে জানা গেছে, হাইআ কোনো অবস্থাতেই কওমীর স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট ভুলুণ্ঠিত হয়, এমন কোনো সিদ্ধান্ত মেনে নেবে না। এমন কি, ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সনদ প্রদানের যে প্রচারণা দেখা যাচ্ছে, তাও হাইআ মেনে নেবে না।
আশ্চর্য লাগে, উড়োখবরে কান দিয়ে কিছু অনলাইন নিউজপোর্টাল হাইআ ও দেশের শীর্ষ আলেমদের নিয়ে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে। তারা এ সংক্রান্ত নিউজ করার পূর্বে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ও (তাদের দৃষ্টিতে)অভিযুক্তদের সাথে কি সামন্যতম যোগাযোগ করেছেন? কিছু ফেবু এক্টিভিটিস্টও এই অপপ্রচারে মেতে উঠেছেন। কারো পপ্রতি বিদ্বেষ বা মতের ভিন্নতার দরুণ বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী বক্তব্য ও ধৃষ্টতাপূর্ণ মন্তব্য করে আলোচনায় আসা ও পত্রিকার কাটতি বাড়ানোই কি তবে উদ্দেশ্য।

স্বীকৃতি আসবে কি না, সরকার দেবে কি না, তা প্রমাণ করা আমার বক্ষমান লেখার উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হচ্ছে, হাইআতুল উলইয়া ও তার নীতিনির্ধারক বুজুর্গ আলেমদের নিয়ে যে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে, তা যে কেবল অমূলক সন্দেহ, অবাস্তব কুৎসা ও বুজুর্গ আলেমদের প্রতি বীতশ্রদ্ধা ছড়ানো ছাড়া কিছুই নয়, সেটাই প্রমাণিত করা।
কওমী ছাত্রদেরকে বুজুর্গদের নামে কুৎসা রটানো ও তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষনের যে ইন্ধন দেয়া হচ্ছে, তা কি মোটেও উচিৎ হচ্ছে? আমরা চাই, হীন ষড়যন্ত্র থেকে মুক্ত থাক কওমী মাদরাসা। নিরারাপদ থাকুন আমাদের আকাবির আলেমরা। যদি কওমীর স্বার্থবিধ্বংসী কোনো স্বীকৃতি আসে, তাহলে অবশ্যই তা মেনে নেবো না আমরা। প্রয়োজনে আবারও ময়দান রক্তাক্ত হবে, তবু বেঁচে থাকবে কওমী মাদরাসা, স্বকীয় সম্মান ও স্বতন্ত্র প্রকৃতি নিয়ে।

মীম সুফিয়ান
তরুণ আলেম,কবি, প্রাবন্ধিক,

লেখকের ফেইসবুক ওয়াল থেকে।