কনে দেখা আলো।

আঁখি সিদ্দিকা: জানলার ওপারে আজ আকাশটা একটু বেশি নীল লাগছে, মাঝে লুকিয়ে থাকা গোলাপি রংটুকু ফুটতে গিয়েও আড়াল হয়ে যাচ্ছে পাশের বাসার পেয়ারা গাছের পাতায়। সারাদিনের ক্লান্তিটুকু পঙ্খীরাজের কাছে গঁচে দিয়ে আবার বেরিয়ে পড়া সন্ধ্যার আগে। সন্ধ্যা হতে এখনও খানিকটা বাকি, এই আলোটাকে মা কনে দেখা আলো বলতো, বলতো সৌমের জন্য বৌ দেখবো এই আলোয়। শুনেছি ফটোগ্রাফারদের জন্য এই আলোটা বিশেষ উপাদেয়। সেদিন কেন্দ্রের ছাদে জাহিদ ভাই বলছিলেন, তার এক রুমমেট ছবি তুলতো, শুক্রবার দুপুরে খেয়ে তারা ঘুমিয়েছে, হঠাৎ তার বন্ধু খালি গায়ে, লুঙ্গি পরে ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে দৌড়, জানালা দিয়ে গেঞ্জি ছুড়ে দিয়েছিল, তারপর কোথায় গেছিল, ফিরে আসলে বোঝা গেল, সে আসলে ছুটেছিল আলোর পিছে। অদ্ভুত সব ছবি তুলেছিল, আলোর খেলায়। এই একলা আকাশের রঙের খেলা দেখা ছাড়া এই আলোর বিশেষ কোনো দিক কি আছে, আমার? ক্যাম্পাস ছাড়ার কয়েকদিন আগে নোট নেবার জন্য অধীশা ডেকেছিল পাবলিক লাইব্রেরিতে, ওর জন্য প্রায় দু’ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর ও এসে যখন ক্যাফেটরিয়ার নাম জানা ঝাঁকড়া পাতাওয়ালা গাছটার সামনের টুলটাতে বসে পড়ল, হঠাৎই আলোটা ওর ঘামমুখে এসে চিকচিক করে উঠল, আমি কি সেদিন ওকে অন্যরকমভাবে দেখেছিলাম, আজও রক্তে কেমন ঢেউ ওঠে? অধীশা কি সেদিন কিছু বুঝেছিল? বুঝতে বুঝতেই ক্যাম্পাস ছাড়ার সময় হয়ে গেল, তারপর।


তারপর এখন উঠতে হবে, নতুবা এসি বাসটা মিস্করবো, আর ঘামতে ঘামতে বনানী পৌঁছানো, অসম্ভব! পাবলিক সার্ভিসে চেহারাই তো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সকালের আমি’র অফিস ড্রেস আর সন্ধ্যার আমি’র অফিস ড্রেসেই আমি বদলে যাই অনেকটা। সরকারি চাকুরে আর অ্যাম্বাসি চাকুরের পার্থক্যটা অনেকটা কেনডি আর পেপারমিল চকলেটের পার্থক্যের মতো। রেডি হয়ে নামতেই সিকিউরিটির কমন ডায়ালগ, স্যার, লিফট নষ্ট। ভালো ছিল কখন, ক্যান ওঠনের সময় তো ভালোই ছিল, বলেই একগাল হাসি। এই লোকটাকে এই হাসিটার জন্য কিছু বলতে পারি না। রোজ বারোতলা হেঁটে নামো না হয় ওঠো, সকালে মর্নিংওয়াক না করলেও চলে। ম্যানেজারকে কমপ্লেন করেও কোনো লাভ নেই। যে তেলী, সেই লিয়াকত আলী। এত কম ভাড়ায় দক্ষিণমুখো বড় জানালাওয়ালা ফ্লাট পাওয়াও মুশকিল। আর পঙ্খীরাজকে ছেড়ে যাওয়া? যেদিন এলাম সেদিনই তন্বি জানালাটার নাম দিয়েছিল পঙ্খীরাজ। ঘরগুলোতে তন্বি যেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। নামতে নামতে হাসি এলো, আজ কি ওই আলোটার জন্য মনটা এত ফুরফুরে লাগছে। রোজ প্রায় ট্রাফিক জ্যামে আলোটাকে আটকে থাকতে হয় কোনো ইলেকট্রিক তারে নতুনা কোনো বাসের মাথায়, বা কোনো বাড়ির ছাদে।
ফিরতে ফিরতে রোজ প্রায় বারোটা বাজে, যদিও অফিসের গাড়ি পৌঁছে দিয়ে যায়। যাওয়ার সময় ইচ্ছে করেই গাড়ি নেই না। একটু ঢিলেঢালাভাবে অফিস যাওয়াটা বেশ উপভোগ করি আমি। আজ কি যাব একবার ওর কাছে? না, আজ না, অনেক রাত হয়ে গেছে, উজ্জ্বল ভাই কি মনে করবেন?
এত রাতে আবার কোথায়? আর যাওয়া কি ঠিক হবে? কেন যাব? কি করতে পারব আমি? শনিবার কি একবার যাব? ওর সাথে প্রথম দেখাও তো শনিবারেই। শনিবার চারটা থেকে অফিস। সকালের অফিসের অফ ডে থাকায় দুপুরের সেশনই নিয়েছিলাম। অফিসের গাড়িও ছিল না সেদিন, ছুটি হয়ে গেল তাড়াতাড়ি। মাস তিনেক আগের কথা। আমেরিকার হাইকমিশনার আসা উপলক্ষে সব গাড়ি রিজার্ভ। তখন নির্বাচন নিয়ে খুব তোলপাড় দেশে। নিরাপত্তা দরজার এপার-ওপার কোথাও নেই। বাসায় যেতে ইচ্ছে করল না, তন্বি তার বেশ কিছুদিন আগেই চলে গেছে বেলজিয়ামে ওর নতুন বন্ধুর সাথে। আমি হাঁটতে হাঁটতে বনানী রেললাইন ক্রস করে ডানে ঘুরব, এমন সময় মনে হলো আদনানের কথা, ও বলেছিল, এখানে কোথাও ওরা থাকে, নিয়েও যেতে চেয়েছিল। শরীরটাও কেমন লাগছে, কখনও তো যায়নি, কি হবে গেলে? আরে পাপ-পুণ্য কে এত হিসাব করে? আদনানকে একটা ফোন করব? না, তা হলে ও বুঝে যাবে আমি এসব পাড়ায় যাই। মনে পড়ল ফাইনালের আগে ফিল্ডওয়ার্ক করেছিলাম লালমাটিয়ার উৎসে। উৎসে রোজি ছিল ওদের প্রধান। ভাইয়া ভাইয়া ডেকে অস্থির হতো, উৎস ওদের জন্য একটা পুনর্বাসন করেছিল, নিজ হাতে ওরা দেশি খাবার রান্না করে বিক্রি করত, কাস্টমার হতো অনেক। কিন্তু বেশিদিন চলেনি কি এক অজানা কারণে। পরে যে যার পথে চলে গিয়েছিল, রোজি মাঝে মাঝে ফোন করে ওর খবর বলত, কখনও আগ বাড়িয়ে ফোন করা হয়নি। ওর কথা মনে পড়তেই মোবাইল ঘেটে ফোন দিলাম, জেগেই ছিল, পাশে অনেক মেয়ের হাসির শব্দ। কি ভাইয়া, এত রাইতে রোজির কথা মনে পড়ল, আইজ জীবনের প্রথম ফোন দিলেন, বলেন, কি কামে লাগতে পারি? আমি ওকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যতটুকু বলা যায়, বললাম, ওর বলা ঠিকানামতো গেলাম, রাত তখন প্রায় ৮টা হবে। রোজি গলির মোড়েই দাঁড়িয়েছিল, দেখেই আঁতকে উঠে বলল, আরে ভাইয়া আপনি তো পুরাই পাল্টি গেছেন, হিরো আর কি? চলেন চলেন। কি ধরনের মাল লাগবো? বলেন দেখি। আমি রোজির সামনে অপ্রতিভ হয়ে চুপ করে রইলাম। প্রসাধনীর গন্ধে দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। এখান থেকে ওখান থেকে পিলপিল করে মেয়েরা বের হচ্ছে, কেউ কেউ এক একজনকে কোমর জড়িয়ে ছোট ছোট ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকছে, বের হচ্ছে। দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ, খোলার শব্দ উভয়ই ক্যাচক্যাচ। পুরনো বাড়ি। কোথাও কোথাও প্লাস্টার খুলে ঝুলে পড়ছে বালি। ভাইয়া, কি ভাবেন, বলেন তাড়াতাড়ি। এই বারান্দায় এইভাবে খাড়াইয়া থাকা যাইবো না। মুখ ফসকে বের হয়ে গেল, সুন্দর, আর তুমিই তো ভালো বুঝবা। এইটা কইছেন কামের কথা। আমার চয়েজমতো দিবো তো? ঠিক আছে। একটি মেয়ে এগিয়ে আসলো দুলতে দুলতে, বললো, আইজ আমি কারোর পাই নাই। প্লিজ, আমি নিয়া যাই, বলেই আমার হাতে টান মারলো। রোজিও আমাকে হেঁচকা টানে হাত ধরে হনহন করে এগিয়ে যেতে যেতে বললো, সর্মাগী, সারাক্ষণ খাই খাই। পশ্চিম দিকে শেষ মাথার একবারে কোণের ঘরে আস্তে আস্তে দরজায় দুবার কড়া নাড়লো, কুসুম আমি রোজি, দরজাটা ভেজানোই ছিল, ঘরে ঢুকতেই একটা গন্ধ নাকে আসলো, জেসমিন পাউডার বোধহয়। রোজি কুসুমকে দেখিয়ে বললো, এসএসসি পাস, শিক্ষিত বলেই আপনার জন্য এরই আমার পছন্দ। কুসুম এইডা আমার ভাই, আলাদা কেয়ার নিবি। বলেই রোজি বেরিয়ে গেল, মেয়েটি একটি কথাও বললো না। ঘরের ভেতর জিনিস বলতে একটা খাট, লাল রঙের একটা চাদর, টেবিলের ওপর টিভি, একটা সিডি প্লেয়ার, একটি ঘোলা আয়নার ড্রেসিং টেবিল, টেবিলের ওপর কিছু প্রসাধনী। মেয়েটি খাটের এক কোণে বসে ছিল, আমি কাছে যেতেই বললো দরজার সিটকিনি খোলা, আমি লাগিয়ে দিয়ে পাশে বসলাম। আমার শরীরে তীব্র ইচ্ছাটা এখানকার গলির মোড়েই বাতাসে মিইয়ে গেছে। কিন্তু এসে পড়েছি, কি আর করা সময়টা পার করে যেতে হবে। নতুন অভিজ্ঞতাও কম নয়।



Ñ তোমার নাম তো কুসুম। মেয়েটি ঘাড় নাড়লো।
Ñ তুমি কথা বলতে পারো না, ঘাড় নেড়েই হ্যাঁ বললো।
Ñ এই লাইনে নতুন? আবারও? ঘাড় নাড়ছো?
Ñ এবার কথা বললো, কাজ করেন, আমি রেডি। বলেই বুকের ওপর থেকে শাড়ির আঁচলটা সরিয়ে ফেললো, নিটোল, সুন্দর গড়ন।
শ্যামলা মুখে সাদা পাউডারে মায়াবী ভাবটা কমে যায়নি এতটুকু।
Ñ আমি জানতে চাইলাম, কি কাজ? বললো, যে কাজে আসছেন।
ভাষায়ও সাবলীল। কুসুমের প্রতি আমার আগ্রহ বেড়ে গেল, ওকে পড়তে ইচ্ছে করলো।
Ñ আমি বললাম, কাজ তো করছিই।
Ñ ও বললো, না, আপনি যে কাজে আসছেন।
Ñ কুসুম আমি যে কাজে আসছি, তা করছি, তুমি শাড়ির আঁচলটা উঠাও আমার অস্বস্তি হচ্ছে।
Ñ এই লাইনে ওই শব্দগুলো নাই। এখানে অস্বস্তি নাই, সবই স্বস্তি। শান্তির জন্যই তো আসেন আপনারা।
হঠাৎ মনে পড়ে গেল, আমারে দুদ- শান্তি দিয়েছিল নাটরের বনলতা সেন। তবে কি জীবনানন্দের বনলতা সেন কি কোনো এক কুসুম?
Ñ কুসুম তোমার বাড়ি কোথায়?
Ñ সেইটা জেনে আপনার কি হবে?
Ñ শোনো কুসুম এখন তুমি আমার, আমি যা বলবো, তাই তুমি করবে, আর আমি যা জানতে চাইবো তুমিই তাই উত্তর দেবে।
Ñ ও মাথা নিচু করলো, বললো কুষ্টিয়া।
Ñ কুষ্টিয়া কোথায়?
Ñ জৈনতলা।
Ñ তুমি কি করে এখানে এলে? কেনই বা এলে?
Ñ ও আবারো চুপ করে রইলো।
Ñ আমি বললাম, কুসুম আমি তোমার সাথে গল্প করবো, এটাই আমার কাজ।
Ñ ও বলতে শুরু করেছিল।
Ñ কিন্তু দরজায় কড়া নাড়া, রোজি চিৎকার করছে, ভাইয়া টাকা লাগবো না আইজ যান, পুলিশের রেইড হতে পারে আইজকে।
Ñ আমি কুসুমের হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম।
ফেরার পথে কুসুমের বড় বড় দুচোখের কোলে মুক্তোর মতো ঝুলেছিল পানি। বাসায় ফিরে সারারাত ঘুমোতে পারি নাই। বারবার কুসুমের চোখ, মলিন অথচ মায়া ছড়ানো মুখটা মনে পড়ছিল। ওইদিন হঠাৎই তন্বিকে স্বপ্ন দেখেছিলাম, হো হো করে আসছে, বলছে কি আমাকে ব্লেম করেছিলে, এখন যে তুমি একটা চরিত্রহীন। আমি চরিত্রহীনতার সংজ্ঞা জানি না। মাথা কাজ করছে না। ঘুম ভেঙে পানি খেয়ে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম, তন্বিকে খুব মনে পড়ছিল, তন্বির জিদ, একগুয়েমি শেষে ফ্রেঞ্চ শিখতে গিয়ে বেলজিয়াম ছেলেটার প্রেমে পড়া। চলে গেল দুবছর হতে না হতে। মা, বড়পু খুব আদর করে বৌ করে এনেছিল তন্বিকে।
সারাদিন অফিসের চাপে ভুলে গেলাম কুসুমকে। পরের শনিবার আবার গেলাম। তারপর আবার। পরপর চার শনিবারেই ওকে জানা হলো অনেকটা। সেই একই রকম জানালার দিকে কোনাকুনি মুখ করে বসে থাকা। বলে যাচ্ছিল ওর কথা।
বাবা পোস্ট অফিসে কাজ করতো। মা আর দুভাই নিয়ে সাজানো সংসার। ওই সবার বড় ছিল। স্কুলে পড়ার পাশাপাশি হাতের কাজ শিখেছিল কুসুম। গায়ের রং চাপা থাকার কারণে মা-বাবা চিন্তা করতো খুব, কালো মেয়ে কীভাবে বিয়ে দেবে। কিন্তু দশম শ্রেণিতেই প্রেম হয় শফিকের সাথে। বাপ-মা মেনে নেবে না, শফিকের বাপ-মারও একি অবস্থা। ঝড়-জলে এসএসসি পাস করলেও আর দেরি করার উপায় ছিল না ওদের। কুষ্টিয়া সদরে এসে কাজী অফিসে কলমা পড়ে বিয়ে করে ওরা, তারপর পাড়ি দেয় ঢাকায়। কোনোরকমে গ্রাম সম্পর্কীয় কাকার বদলৌতে ওরা কাজ পায় গার্মেন্টসে। গাজীপুরেই থাকতে শুরু করে। দিনগুলো কষ্টে দুঃখে ভালোই কাটছিল, চার বছরের মাথায় ঘরে একজন নতুন অতিথিই এলো, ওরা নাম রেখেছিল তিশা। তিশাকে নিয়ে একদিন ওরা দুজন মার্কেটে গেছে, তিশা তখন কোলে, গার্মেন্টসের এক মাস্তান বড় ভাইয়ের চোখ ছিল কুসুমের দিকে। সেদিন ওদের ডেকে নিয় যায় সুপারভাইজারের বাড়ি, মিথ্যা কথা বলে। তারপর শফিককে বেঁধে রেখে কুসুমকে ওরা কয়েকজন ভোগ করে উপর্যুপরি। শফিককে মেয়েসহ ছেড়ে দিলেও কুসুমকে ছাড়ে না। পরদিন থানায় শফিক জানালে শফিককে মার্ডার কেসের আসামি করে জেলে পাঠায় ওরা। এই গল্পগুলো শুনতে আমি রোজ শনিবার যেতে থাকি, কেমন টান অনুভব করি, কুসুমের জন্য। দুমাস পরে মনে হলো কুসুমের জন্য তো কখনও কিছু নিয়ে যাই নি। আজ কিছু নেবো। রোজিও বোঝে আমি ওর সাথে গল্প করি, তাই ঘণ্টা হিসেবে রেট খুব কম রাখে। আর মাঝে মধ্যে খাবার নিয়ে যাই। কুসুম কেমন উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে, বুকটা যেন খালি হয়ে আসে, হুহু করে বাতাস আসা-যাওয়া করে। গত মাসে প্রথম শনিবার অফিস শেষ না করেই বেরিয়ে গেলাম, ঘুরছি শপিংমলে কি কিনবো কি কিনবো, কিছুই বুঝতে পারছি না। হঠাৎ তন্বির কথা মনে হলো, ওকে জন্মদিনে কি দেবো জানতে চাইলে, বলেছিল, নূপুর দিও এবার আমাকে; কিন্তু তার আগেই।
হ্যাঁ, নূপুর কিনবো, আমি তো ভালো বুঝি না। কলিগ মৌকে ফোন করলাম, মিথ্যা বলতে হলো, বললাম বোনের জন্মদিন নূপুর কিনবো কোথা থেকে, ও আড়ং-এর কথা বললো। বেশ সময় নিয়ে নূপুর কিনে, চলে এলাম কুসুমের কাছে। কুসুমকে আজ কৃষ্ণকলির মতো লাগছে, ন্যাচারাল। আজ কোনো পাউডারের ছটা নেই, সাজ নেই। মিঠেকালো অপূর্ব সুন্দর এক মানসী আমার সামনে বসে আছে। আমি দরজার সিটকিনি তুলে দিলাম। কুসুম একটু আঁতকে উঠে বললো।
Ñ আজ বুঝি কাজ করবেন?
Ñ আরে আমি কি রোজ আকাজ করি?
ও হাসলো যেন বেলি ফুল ফুটে উঠলো।
Ñ কুসুম আজ তোমার জন্য আমি একটা উপহার এনেছি, তুমি নেবে?
Ñ কুসুম অপ্রস্তুত তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ, তারপর আস্তে আস্তে বললো, নেবো।
Ñ বললাম, না হাতে দেবো না, আমি নিজ হাতে পরিয়ে দেবো।
Ñ ঠিক আছে দিন বলে আমার দিকে তাকলো।
Ñ তোমার পা দুটো বের করো, নইলে কীভাবে পরাবো? বলতে বলতে প্যাকেট খুলে নূপুর জোড়া বের করে ওর দিকে তাকালাম।
Ñ ও মুখে হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো,
Ñ কি হয়েছে কুসুম? ওকে আমি জড়িয়ে ধরতে গিয়ে থেমে গেলাম, কি হলোটা কি?
পা বের করো, ও বের করছে না দেখে ওর শাড়ির নিচ থেকে আমি টেনে বের করতে চাইলাম, একি পা কোথায়?
একটা পায়ের অর্ধেক আমার হাতে এলো, আরেকটি পা নেই। আঁতকে সরে গেলাম।
Ñ ওর হাত চাঁপা মুখ আমি উঁচু করে ধরে চিৎকার করলাম, কুসুম একি? আমাকে বলো… কুসুমের কান্নার ধমকে খাট নয় পুরো ঘর কেঁপে উঠলো, কুসুম বলো। আমাকে বলো। ওর চোখ মুছিয়ে, ওকে বুকে জড়িয়ে আদর করে বললাম, কুসুম আমায় বলো। কি হয়েছে তোমার? কেন লুকিয়ে ছিলে আমার কাছে?
কুসুমের বড় বড় চোখ দিয়ে তখনও পানি ঝরছে, তবে উথাল অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে মিইয়ে এসেছে।
ও সেদিন যা বলেছিল, তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তবুও শুনেছিলাম, কুসুমের জন্য সেদিন শফিকও নূপুর কিনেছিল। ওদের ম্যারেজ ডে ছিল। শফিককে জেলে নেবার পর কুসুমকে ওরা ছেড়ে দিলেও কুসুম সুস্থ থাকেনি। এক প্রকার মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিল। তিশার দেখাশোনার ভার নেয় পাশের ঘরের নানী, যিনি রোজির মা। শফিকের যাবজ্জীবন হয়েছিল। কুসুম ওই অবস্থাতেই রেললাইনের পাশে বসে থাকতো, এটা ওটা কুড়িয়ে খেতো। কোনো এক ফিরতি ট্রেনে ওর অ্যাকসিডেন্ট হয়, এবং তাতেই ওর পা হারায়, পা হারিয়ে সরকারি হাসপাতালে প্রায় চার বছর চিকিৎসার পর সুস্থ হয় কুসুম। চিকিৎসায় ধীরে ধীরে কুসুমের মানসিক অবস্থাও ভালো হয়। তিশাকে খোঁজে, শফিককে খোঁজে। তিশাকে নিয়ে গেছে তিশার দাদা-বাড়ির লোকেরা। আর শফিক এখনও ফেরেনি জেল থেকে।
তারপর রোজির সহযোগিতায় কুসুমের জায়গা হয়, কুড়িলের এই গলির মোড়ের প্লাস্টারহীন বাড়িতে। কুসুম আর ফিরে যেতে পারে না ওর নিজের বাড়ি। কুসুমের আসল নাম কুসুম ছিল না, তৃপ্তি বিশ্বাস।
ব্রাহ্মণের মেয়ে মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করে মুসলিম হয়েছিল, ধর্ম ছাড়া, কূল ছাড়া তৃপ্তি স্বামীর কাছে তাহেরা থাকলেও পরে হয়েছিল কুসুম। সেই নূপুর রাখেনি কুসুম, আমায় বলেছিল, আপনি আর আমার কাছে আসবেন না।
কুসুম কি শফিকের জন্য আজও অপেক্ষা করে? আমার জানা হয়নি। সেদিনের সব মেয়েগুলি আমার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। ওদের কি ধারণা হয়েছিল আজও আমি জানি না। কেবল রোজি এগিয়ে এসে বলেছিল, এই যে ভাইয়া, আপনার সব টাকা, আপনাকে ঠকানোর কোনো ইচ্ছা নাই। আমি সেই সন্ধ্যা হবার আগের আলোটা পেরিয়ে এসেছিলাম কুসুমকে পেছনে ফেলে।
গাড়ির এফএম-এ মাত্র মান্নাদে’র ‘আমি তোমার প্রেমের যোগ্য তো নই’ গানটি শেষ হতেই উজ্জ্বল ভাই বলে উঠলো, কি ব্যাপার সৌম কোথায় হারিয়ে গেলেন? ঘুমিয়ে পড়লেন না-কি? বাবুল আপনাকে ডাকছে, বাসায় চলে এসেছেন তো?
Ñ না ! উজ্জ্বল ভাই, যা জ্যাম ছিল, একটু চোখটা লেগে আসছিল।
Ñ ওকে গুড নাইট। বাসার গেটে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটা হুস করে বেরিয়ে গেল। সিকিউরিটি গার্ড জামাল পিটপিট করে তাকিয়ে বললো,
Ñ ভাইয়া, শরীর খারাপ না-কি?
নিজ থেকেই লিফটের সুইচ বাটনটা জামাল প্রেস করে দিল। দরজার তালা খুলে অন্ধকারে খুঁজতে লাগলাম সন্ধ্যার আলোটুকুন…

Post a Comment

0 Comments