আশা ও আশঙ্কার দোলাচলে কওমী স্বীকৃতি। চাই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন

মীম সুফিয়ান।১১ এপ্রিল ২০১৭। বাংলাদেশের ইতিহাসেরর পাতায় স্থান পেলো এক ঐতিহাসিক ঘোষণা। বহুল আকাঙ্ক্ষিত, বহুল প্রত্যাশিত, লক্ষ লক্ষ কওমীপ্রেমি ইসলামী জনতার প্রাণের দাবি কওমী মাদরাসা সনদের অানুষ্ঠানিক স্বীকৃতির ঘোষণা এলো। গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩০০ আলেমের এক সাড়ম্বর অনুষ্ঠানে দেন এই ঐতিহাসিক ঘোষণা। প্রধানমন্ত্রী স্থান করে নেন লক্ষ লক্ষ কওমীপ্রেমির হৃদয়ে। অন্যরকম এক আমেজ করতে থাকে কওমী অঙ্গন জুড়ে। ঘোষণার প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী কারিকুলাম তৈরির দায়িত্ব দিয়ে যান আমাদের আলেম উলামার হাতে।
 ৬ বোর্ডের সমন্বয়ে গঠন করা হয় সর্বোচ্চ সম্মিলিত বোর্ড বা পরিষদ 'আল-হাইআতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কাওমিয়্যাহ'।  ব্যাপক প্রস্তুতি ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয় দেশে প্রথম অভিন্ন প্রশ্নে দাওরায়ে হাদীসের পরীক্ষা। স্বীকৃতি ঘোষণার ৫/৬মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও পরীক্ষা ছাড়া স্বীকৃতি বাস্তবায়নের পথে আর তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যায় না হাইআ ও সরকারের। অবশেষে চলতি মাসে কারিকুলাম ও গঠনতন্ত্র পর্যবেক্ষণ এবং আইনি খসড়া তৈরির জন্য সরকার গঠন করে ৯ সদস্যের এক কমিটি। এটা করা হয় সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়ারই অংশ হিসেবে।
এদিকে হাইআও তার গঠনতন্ত্র ও কারিকুলাম সরকারি অফিসে জমা দেয়। জমাকৃত গঠনতন্ত্র ও কারিকুলাম পর্যবেক্ষণ এবং আইনি খসড়া তৈরির পর ৯ সদস্যের কমিটি কর্তৃক তা শিক্ষামন্ত্রণালয়ে জমা দেয়ার পর শিক্ষামন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট পরিষদ হাইআর সাথে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হবার কথা। এই প্রক্রিয়ায়ই পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে গিয়ে পৌঁছাবে কওমী সনদের স্বীকৃত। এ পর্যন্ত কওমীপ্রেমিদের অনেকেই ব্যাপক সন্দেহ পোষণ করে আসছিলেন স্বীকৃতির বাস্তবায়নের ব্যাপারে। তাঁরা শুঁকতে পাচ্ছিলেন কোনো ষড়যন্ত্রের গন্ধ। যদিও সচেতন অনেকেই এই সমস্ত প্রক্রিয়াকে নিয়মতান্ত্রিকতা জ্ঞান করে আসছেন।
কিন্তু ১৭ অক্টোবর রাতের খবর শঙ্কিত করে তুলেছে আশাবাদিদের অন্তরকেও।


খবরে এসেছে, ইসলামি আরবি বিশ্বিবদ্যালয় কওমি ও আলিয়া স্তরের উচ্চশিক্ষার সনদ দেবে। একনেকে এ সংক্রান্ত একটি বিশেষ প্রকল্পও মঞ্জুর করা হয়েছে।

খবরে বলা হয়, 'ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন’ প্রকল্পের আওতায় ২০ দশমিক ১৫ একর জমিতে স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ করে বিশ্ববিদ্যালয়টির সামগ্রিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে।

৪১৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে চলতি সময় থেকে ২০২১ সালের জুন মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এর মধ্যে নতুন স্থায়ী ক্যাম্পাসে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করবে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে আরবি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বল্পতায় মাদরাসা পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ কম। এ বিবেচনায় আধুনিক বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হচ্ছে।

এর মাধ্যমে উচ্চস্তরের মাদরাসা শিক্ষার্থীদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করা হবে। ফলে এখানে উচ্চশিক্ষা নিয়ে কোনো শিক্ষার্থী বেকার থাকবেন না। নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর দারিদ্র্য বিমোচনও হবে।

আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণও করবে বিশ্ববিদ্যালয়টি।

কিন্তু কওমী মাদরাসা তো এমন স্বীকৃতি চায় নি। কওমী মাদরাসা চেয়েছে তার স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্টাবলি অক্ষুণ্ন রেখে নিজেদের অধীনে সনদ প্রদানের ব্যবস্থাপনা। অবশ্য অনেকে এই সনদ প্রদানের জন্য জাতীয় শিক্ষাধারার প্রক্রিয়ার মতোই স্বতন্ত্র কওমী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সনদ প্রদানের পক্ষে মত রাখছিলেন। সেটা একটি জাতীয় কওমী বিশ্ববিদ্যালয় বা ৭ বিভাগে ৭টি কওমী বিশ্বদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই হোক। মধ্যখানে ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সনদ প্রাপ্তির সিদ্ধান্ত বা প্রস্তাবনা কেউ কামনা করি নি আমরা। এর দ্বারা ককওমী মাদরাসার স্বাতন্ত্র্যে আঘাত আসবে বলেই মনে করেন সচেতন কওমীপন্থীরা।
এই সংবাদ কওমী সনদের স্বীকৃতি ও কওমী মাদরাসার অস্তিত্বের প্রশ্নে আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে কওমিপন্থীদের মনে।
সরকারের ৯ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন, কমিটিতে সামীম আফজালকে রাখা, বেফাক মহাসচিবের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে অনানুষ্ঠানিক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ, সামীম আফজালের সাথে বেফাক মহাসচিব ও হাইআর কো-চেয়ারম্যানের সাক্ষাৎ, প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা কর্তৃক কেরানিগঞ্জে ৩ একর জমি প্রদান এবং হাইআ কর্তৃক তা টাকার বিনিময়ে গ্রহণের সিদ্ধান্ত -এসব বিষয়কেও কিছু কওমীপন্থী সন্দেহের চোখে দেখছিলেন। তর ওপর কিছু স্বার্থান্বেষী অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও অনলাইন এক্টিভিটিস্ট এসব বিষয় নিয়ে জলঘোলার চেষ্টায় লেগেই আছে। তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় অপপ্রচার চালিয়ে হাইআর নীতিনির্ধারকদের বিররুদ্ধে সরলপ্রাণ কওমী শিক্ষার্থীদেরকে খেপিয়ে তোলার চেষ্টায় নিরত আছে। বস্তুনিষ্ঠাহীন বক্তব্য ও ধৃষ্টতাপূর্ণ মন্তব্য তারা করে বেড়াচ্ছে দেশের শীর্ষস্থানীয় বুজুর্গ আলেমদের সম্পর্কে। মানুষের মনে আলেমদের সম্পর্কে অশ্রদ্ধার বীজ বপন করার প্রয়াস চালাচ্ছে। এর মধ্যে কোথাকার কোন স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক মহলের ৩০ আসনের চুক্তির উড়োখবরকেও তারা হাইআতুল উলইয়া ও কওমী সনতের স্বীকৃতির সাথে মিলিয়ে তালগোল পাকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
সচেতন কওমীমহল বিশ্বাস করে, আমাদের বুজুর্গরা যা করছেন, তা পরামর্শ ও বিচক্ষণতার আলোকেই করছেন। সরকারের ৯ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন, কমিটিতে সামীম আফজালকে রাখা এবং হাইআর তা মেনে নেয়া, বেফাক মহাসচিবের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে অনানুষ্ঠানিক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ, সামীম আফজালের সাথে বেফাক মহাসচিব ও হাইআর কো-চেয়ারম্যানের সাক্ষাৎ, প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা কর্তৃক কেরানিগঞ্জে ৩ একর জমি প্রদান এবং হাইআ কর্তৃক তা টাকার বিনিময়ে গ্রহণের সিদ্ধান্ত-এসবই করা হচ্ছে কওমী মাদরাসার স্বকীয়তা বজায় রেখে প্রতিশ্রুত ম্বীকৃতি বাস্তবায়নের পথে সহায়িকা হিসেবে। নতুন কাউকে হাইআর লিয়াজো কমিটিতে ঢুকানোর গুজবও মিথ্যা ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত। হাইআ থেকে কারো দূরত্ব প্রদর্শন এটা কেবলই তার ব্যক্তিগত বিষয়। হাইআ নিজপথে হাঁটতে সেদিকে দৃষ্টি দেবার প্রয়োজন অবশ্যই নেই।
সবশেষে কথা হলো, কওমী আমাদের।  স্বীকৃতি আমাদের অধিকার। সুতরাং সরকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত নয়। চূড়ান্ত হবে উভয়ের আলোচনা সাপেক্ষে কওমীর স্বার্থ বজায় রেখে যে সিদ্ধান্ত হবে, সেটাই। প্রত্যাশা, আমাদের মাথার মুকুটেরা এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেববেন না, যাতে কওমীর স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে হয়। যদিও আশঙ্কা ও সম্ভাবনার দোলাচলে কওমী স্বীকৃতি। তবু আমাদের আশা, স্বীকৃতি আসুক। নির্ভেজালভাবেই আসুক। হাইআ হোক রাজনীতিমুক্ত সম্মিলিত কওমী প্লাটফর্ম। বাস্তবায়ন হোক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির।

Post a Comment

0 Comments