সে স্বপ্নে এসেছিল

~সালাউদ্দীন জাহাঙ্গীর~

মারুফা মাদরাসার বোর্ডিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁচামরিচ খাচ্ছে। গোল গোল সাইজের ধানী মরিচ। দেখতে কালো, অসম্ভব ঝাল। ঝালের কারণে অবশ্য মারুফার চেহারায় হা-হুতাশধর্মী কোনো ভাবান্তর ঘটছে না। কোনো চিৎকার বা গোঙানি নেই, নীরব মরিচভক্ষণ।


ঝালের চোটে ফর্সা গাল দুটো টকটকে লাল হয়ে ওঠেছে। পাঁচটা খাওয়ার পর চোখ দিয়ে জল পড়তে শুরু করে, সাতটার পর যোগ হয়েছে নাকের পানি। এই মুহূর্তে নবম মরিচ চলছে। পানি কোনটা চোখের আর কোনটা নাকের, তফাৎ করা যাচ্ছে না। সেদিকে অবশ্য তার খেয়ালও নেই। সে বোর্ডিংয়ের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে একমনে মরিচভক্ষণ কর্মসাধনে ব্যস্ত।

মরিচ খাওয়ার সময় মারুফা যোগী-সন্যাসীদের একটা সাধনপদ্ধতি এ্যাপ্লাই করছে। সে মরিচ শুধু কামড়িয়ে বা গিলে খাচ্ছে না, যেভাবে ঝাল বেশি লাগে সে সেভাবে চিবিয়ে খাচ্ছে। কাঁচামরিচের খোসার চেয়ে দানায় ঝাল বেশি। সে একটা মরিচ মুখে দিয়ে প্রথমে কচ করে খোসাটা ভাঙছে। ভাঙার পর জিহ্বা দিয়ে খোসা আর দানা আলাদা করে ফেলছে। আগে খোসাটা আলাদাভাবে চিবিয়ে গিলে ফেলার পর দানাগুলো নির্দয়ভাবে চিবুচ্ছে। এতে ঝালের মধ্যে একটা রকমফের করা যাচ্ছে। ঝালও বেশি লাগছে।

ঝাল জিহ্বার উপর যতো চাপ প্রয়োগ করছে সেটা ততো নির্জীব হয়ে পড়ছে। খুব কষ্ট করে জিহ্বা নাড়াতে হচ্ছে। জিহ্বা নির্জীব হয়ে পড়লেও মারুফার রাগ কমেনি। তার যখন খুব রাগ হয় তখন সে একা একা কাঁচামরিচ খায়। এ কারণে বাড়িতে যখনই সে কোনো বিষয়ে রাগ করে তখন তার মা প্রথমেই রান্নাঘরে তালা লাগিয়ে দেন। রান্নাঘরে তালা লাগিয়ে দেয়া মানে মারুফার রাগ অর্ধেক শেষ। কাঁচামরিচ না খেতে পারলে ওর রাগ ফস করে কমে যায়।

: মারুফা, ওখানে দাঁড়িয়ে কী করছো তুমি? পেছন থেকে ডাক দিলেন ফাহমিদা আপা। ফাহমিদা আপা তাদের মাদরাসার সবচে সুন্দরী নারী। শিক্ষিকা তো বটেই, চারশো ছাত্রীর মধ্যে তার মতো সুন্দরী একটাও নেই। এটা মাদরাসার ছাত্রীদের সর্বসম্মত মৌখিক স্বীকারোক্তি।

মারুফা ফাহমিদা আপার ডাক শুনেও কিছু বললো না। যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। হাতের মরিচটা ধরে রাখলো। বুঝতে পারছে, ফাহমিদা আপা তার দিকে এগিয়ে আসছে। মারুফা ভয় পাচ্ছে না। বরং আপার ডাক শুনে তার অভিমানী রাগ আরও বাড়ছে।

: এ্যাই, কী হয়েছে তোমার? এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? কথা বলছো না...? ফাহমিদা আপা মারুফার কাঁধ ধরে নিজের দিকে টানলেন। : ইয়াল্লাহ! কী করছো তুমি? কাঁদছো কেন? তোমার মুখে কী? এতোক্ষণ মারুফার চোখের পানি ছিলো ঝাল আর রাগের মিশেল। ফাহমিদা আপাকে দেখে এবার সে শব্দ করে কেঁদে ফেললো, অভিমানে। 

এতোক্ষণের রাগী মারুফা ফাহমিদা আপার আদরে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। আছড়ে পড়লো আপার বুকে। আপা ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন।

: ওরে আমার সোনা রে! কে বকছে তোমাকে? একবার বলো আমাকে, আমি তাকে মাদরাসা থেকে এখনই বের করে দিবো। আমার ছোট্ট মা’টা আবার কাঁচামরিচ খেয়েছে? ইশ সারাটা মুখ কেমন টকটকে লাল হয়ে গেছে...। এ্যাই বাবুর্চি আপা, জলদি পানি নিয়ে আসেন তো!



০২.




>রাতের বেলা ক্লাসের সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছে। মারুফা আসেনি। ওর জ্বর এসে গেছে। রুমের এক কোণে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। একটু আগে ফাহমিদা আপা এসে ওকে দুধ দিয়ে পাউরুটি খাইয়ে গেছে। খেতে পারেনি, মুখে দিলেই মুখ জ্বালা করে ওঠছে। অল্প একটুখানি খেয়েই শুয়ে আছে।

এখন রাতের খাওয়ার সময়। সবার সঙ্গে দস্তরখানে বসেছে জান্নাত, কিন্তু কিছুই খাচ্ছে না। ভাত নলা বানিয়ে মুখে দিলেও গলার মধ্যে গিয়ে আটকে যাচ্ছে, পেটের দিকে নামানো যাচ্ছে না। নিজের প্লেট রেখে বারবার শুয়ে থাকা মারুফার দিকে চোখ যাচ্ছে। বোর্ডিংয়ে আজকে পাঙ্গাস মাছের ঝোল রেঁধেছে, চেরা পটল দিয়ে। পাঙ্গাস-পটল মারুফার প্রিয় রেসিপি। যেদিন পাঙ্গাসের তরকারি হয় সেদিন মারুফা খুব আয়োজন করে রাতের খাবার খায়। বিকেলবেলা দারোয়ানকে দিয়ে বাজার থেকে শশা কিনে আনে। বোম্বাই মরিচ সবসময় ওর বক্সে রিজার্ভ থাকে, এক সপ্তাহের জন্য তিন-চারটে একসঙ্গে কিনে রাখে। খাওয়ার আগে কুচিকুচি করে শশা কেটে সেগুলো বোম্বাই মরিচ দিয়ে বেশ করে মাখায়। কোনো কোনোদিন চানাচুরও কিনে আনে। মাখানো ঝাল সালাদ আর চানাচুর দিয়ে বড় বড় নলা করে ভাত খায় ও। জান্নাত লুকিয়ে লুকিয়ে ওর খাওয়া দেখে। কী আগ্রহ নিয়ে খায় মারুফা! খাওয়ার সময় অদ্ভুত লাগে ওকে।

দস্তরখানে বসে এ কথা মনে পড়ে জান্নাতের চোখে পানি চলে এলো। টপ করে এক ফোঁটা পানি পড়লো প্লেটে। দস্তরখান থেকে প্লেটটা উঠিয়ে মারুফার পাশে গিয়ে বসলো। মারুফা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। পানপাতার মতো দীর্ঘ ফর্সা মুখটা এখনও লাল হয়ে আছে। গাল-চোখ ফুলে গেছে অনেকখানি। চৌদ্দ বছরের মারুফাকে বাচ্চাদের মতো নিষ্পাপ লাগছে। জান্নাত আস্তে করে ডাক দিলো- মারুফা, এ্যাই মারুফা!

মারুফার চোখের পাপড়িতে বিন্দু বিন্দু জল জমে আছে, টলমল করছে যেন। কী বিরাট ওর চোখ দুটো! মারুফা আস্তে করে চোখ খুললো। মনে হচ্ছে জলের ভেতর থেকে ভেসে ওঠছে দুটো জলপদ্ম।জান্নাতকে দেখে আবার চোখ বন্ধ করে ফেললো। নিচের ঠোঁটটা কেঁপে কেঁপে ওঠলো কয়েকবার, অভিমানে। কিছু বললো না।

: আমার সঙ্গে কথা বলবি না আপুনি? মারুফা জান্নাতের চেয়ে বছরখানেকের ছোট হবে, তাই আদর করে ওকে আপুনি বলে ডাকে।

: না, তোর সঙ্গে আমি জীবনেও কথা বলবো না। বলেই পাশ ফিরে শুলো।জান্নাত ওর কাঁধে হাত দিয়ে ওকে পাশ ফেরানোর চেষ্টা করলো, পারলো না। আবার কান্না শুরু করেছে। জান্নাত আস্তে করে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, তুই যেমন একটুকুতেই রাগ করতে পারিস তেমনি কাঁদতেও পারিস। ওরা যদি এখন তোকে কাঁদতে দেখে তাহলে কী বলবে বলতো? এই দেখ আমি তোর জন্য ভাত নিয়ে এসেছি। আজকে বোর্ডিংয়ে পাঙ্গাস মাছ রেঁধেছে পটল দিয়ে, তোর ফেভারিট আইটেম। আয়, আমার সঙ্গে ভাত খা।

: না, আমি তোর সঙ্গে ভাত খাবো না।

: আচ্ছা আমি মাফ চাচ্ছি। আর জীবনে কোনোদিন তোকে রাগানোর মতো কোনো কাজ করবো না। হয়েছে?

: না।

: না কেন? আমি বড় হয়ে তোর কাছে মাফ চাচ্ছি! কেউ মাফ চাইলে তাকে মাফ করে দিতে হয়, নইলে কেয়ামতের দিন আল্লাহও তাকে মাফ করবেন না।

মারুফা কিছু বললো না। কান্নার সঙ্গে মনের বরফ কিছুটা গলছে সম্ভবত। জান্নাতের ওপর রাগ করেই আজকে মরিচ খেয়েছে ও। অবশ্য মরিচ খাওয়া ওর জন্য নতুন না। রাগ বেশি উঠলে কেউ জিনিসপত্র ভাঙে, কেউ চিৎকার করে, কেউ হাতাহাতি করে; মারুফা মরিচ খায়। 

মাদরাসার সবচে উচ্ছ্বল আর চঞ্চল বলে ভারী বদনাম আছে মারুফা আর জান্নাতের। দু’জনের বন্ধুত্ব যেমন, তেমনি দিনে একবার না একবার ঝগড়াও ওদের নিত্যরুটিন। সপ্তাহে অন্তত সাতদিন একজন আরেকজনের কাছে ক্ষমা চায়, আবার সাতদিনই আঁড়ি দেয়। মাঝে মাঝে ঝগড়ার লিমিটটা একটু বেড়ে যায়। আজকে যেমন গিয়েছিলো।

ঘটনা তেমন কিছুই না। বিকেলে ওরা কয়েক বান্ধবী মিলে গল্প করছিলো। গল্পচ্ছলে ফাহমিদা আপার প্রসঙ্গ চলে আসে। সবাই জানে, ভীষণ চঞ্চল আর উচ্ছ্বল বলে মারুফাকে ফাহমিদা আপা ক্লাসের অন্যদের চেয়ে বেশি প্রশ্রয় দেয়, বেশি আদর করে। মারুফাও ফাহমিদা আপা বলতে অজ্ঞান। আপার সকল কাজে মারুফা সবার আগে। আপার ক্লাসের পড়ায় মারুফা ফার্স্ট। আবার আপার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য গুরুতর লঘুতর যে কোনো অন্যায় কাজেও কেউ তাকে আটকে রাখতে পারে না।

এমনও হয়েছে, ফাহমিদা আপার বকা খাওয়ার আশায় সে ক্লাসের পড়া শিখে যায়নি। কয়েকদিন পরপর সে এই কা- করে। ফাহমিদা আপা বকলেও নাকি ওর ভালো লাগে। 

ফাহমিদা আপা এবং মারুফার মধ্যে একটা গোপন সম্পর্ক আছে, সেটা কেউ জানে না। আপা মারুফাকে একদিন একান্তে ডেকে বলে দিয়েছেন, তুই যখন একা একা আমার রুমে আসবি, তখন আমাকে মা বলে ডাকবি, আপা ডাকবি না।

জান্নাত মারুফার সবচে কাছের বন্ধু। কিন্তু তার শুধু মনে হয়, ফাহমিদা আপা মারুফা আর তার বন্ধুত্বের মাঝে অদৃশ্য একটা দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। দারুণ ঈর্ষা হয় ওর। ফাহমিদা আপা সুন্দরী বলেই হয়তো। শুধু সুন্দরী হলেও কথা ছিলো না, তার কথা, ব্যবহার, পড়ানো সবকিছুই সুন্দর।

এসব নিয়েই মন কষাকষি হয়েছিলো বিকেলে। জান্নাত খুব বলেছিলো ফাহমিদা আপাকে নিয়ে। মারুফাকেও নিয়েছিলো একহাত। জান্নাত শুধু ওকে বকলে কথা কিছু বলতো না, কিন্তু আপার বদনাম মোটেও সইতে পারে না ও। রাগ করে সেখান থেকে উঠে চলে এসেছিলো বোর্ডিংয়ে। বোর্ডিং থেকে মরিচ নিয়েই আচ্ছারকম খেয়েছিলো।



***

মারুফার রাগ ভাঙানোর জন্য জান্নাত আবার বললো, আপুনি, খাবি না আমার সঙ্গে? আমি কিন্তু চলে যাবো তাহলে। আর কক্ষনো তোর কাছে আসবো না। আমি চলে গেলে তখন দেখবো তুমি কার সঙ্গে রাগ করো। জান্নাতের মতো এমন একটা বন্ধু খুঁজে দেখো, সারাজীবনেও পাবে না। চলে গেলাম...!

মারুফা ফুঁপাতে ফুঁপাতে বললো, না।

: তাহলে আয় আমার সঙ্গে ভাত খা। তুই না খেলে আমাকেও না খেয়ে থাকতে হবে! কতোক্ষণ চেষ্টা করলাম, খেতে পারলাম না।

: উঁহুহু...।

: উঁহুহু মানে?

মারুফা বিছানা থেকে উঠে বসতে বসতে বললো, যদি তুই ভাত মেখে খাইয়ে দিস তাহলে খাবো।

ওর কথায় হিহিহি করে হেসে ওঠলো জান্নাত। বললো, ইশশ, রাগকপালি বুড়িটার আবার ঢঙ কতো!

: তুই বুড়ি।

: আচ্ছা ঠিক আছে আমিই বুড়ি, তুই কচি খুকি। কাছে আয়, আমি তোকে নলা বানিয়ে খাইয়ে দিচ্ছি।

মারুফা সারা শরীরে বড় ওড়না জড়িয়ে উঠে বসলো।

: দে, খুব ক্ষুধা লাগছে। এতোক্ষণ আসিস নাই কেন?

: তোর রাগ আছে আমার রাগ নেই বুঝি? আমিও রাগ করে তোর কাছে আসি নাই। তুই আমার ওপর রাগ করে মরিচ খেলি কেন শয়তান?

: আরও খাবো, বেশি বেশি খাবো। এরপর তোর সঙ্গে রাগ করে বোম্বাই মরিচ খাবো, এত্তোগুলা!

: খা, খেয়ে খেয়ে এমন অসুস্থ হয়ে পড়ে থাক। নে, এবার ভাত খা। হা কর দেখি...!

জান্নাত নলা মেখে মারুফার মুখে তুলে দিলো।

ওকে খাইয়ে দিচ্ছে দেখে দস্তরখানে বসা বান্ধবীরা অনেকেই মুখ লুকিয়ে হাসছে। লজ্জা পেলো মারুফা।

: ওরা সবাই হাসছে।

: হাসুকগে! ওরা যা ইচ্ছা তাই ভাবুক, আমার কিচ্ছু যায় আসে না। শুধু তুই আমাকে কখানো ভুল বুঝিস না। কথা দে, আর কখানো আমার ওপর রাগ করবি না!

: আচ্ছা কথা দিলাম। আর কোনোদিন তোর ওপর রাগ করবো না। কিন্তু তুইও কথা দে, ফাহমিদা আপাকে নিয়ে আর কখনো বাজে কথা বলবি না! হাতের তালু দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বললো মারুফা।

: হিহিহি... আমি বাজে কথা বলি নাকি? আপা এতো সুন্দরী বলে আমার খুব হিংসে হয়। ইশ আমি যদি ছেলে হতাম তাহলে সত্যি ফাহমিদা আপাকে বিয়ে করে ফেলতাম। বলেই মারুফার মুখে ঝোল মাখানো এক নলা ভাত তুলে দিলো জান্নাত। 

মারুফা ভাত গিলতে গিলতে বললো, তুই আবার শুরু করেছিস? আমি কিন্তু আর একটা ভাতও খাবো না!

: হিহিহি... দুষ্টুমি করে বলেছিরে পাগলা। তুইই বল, কাউকে ভালোবাসাটা কি অপরাধ? ফাহমিদা আপাকে বুঝি আমার ভালো লাগতে পারে না?

: না। তুই আপাকে নিয়ে অনেক বাজে কথা বলিস।

: তুই তাকে একাই ভালোবাসবি?

: একটা মারবো কিন্তু তোকে!

: আচ্ছা, যতো খুশি মারিস আমাকে। আগে খাওয়াটা শেষ কর।

ভাতের নলা মুখে দিয়েই মারুফার মনে হলো, গলার ভেতরে কী যেনো গলাটা চেপে ধরে আছে। ভাত গেলা যাচ্ছে না, পেটের ভেতর থেকে সব বেরিয়ে আসতে চাইছে। আগেও এমন হয়েছে কয়েকবার তবে আজকের মতো এমন প্রবলভাবে না। আরেকবার চেষ্টা করলো, পারলো না। ভেতর থেকে বমিভাব গুলিয়ে ওঠছে। স্থির থাকতে পারলো না। দৌড়ে গিয়ে বাথরুমের মেঝে বমি করে ভাসিয়ে দিলো।



০৩.

ফাহমিদা আপার ক্লাস মানে পড়ার চেয়েও বাড়তি কিছু। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলেন। পাঁচচল্লিশ মিনিট ক্লাসের ত্রিশ মিনিট পড়া এবং বাকি পনেরো মিনিট গল্প। ফাহমিদা আপার পড়া বোঝাতে পাঁচচল্লিশ মিনিটের পুরোটা কখনোই লাগে না। আরবি সাহিত্য পড়ান, কিন্তু এমন সহজভাবে কঠিন কঠিন বাক্যগুলো বুঝিয়ে দেন, মনে হয় রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তী গল্প পড়াচ্ছেন।

ফাহমিদা আপা অনেক ধনী পরিবারের মেয়ে। ইংলিশ মিডিয়ামে ও’লেভেল পাশ করে মাদরাসায় ভর্তি হয়েছিলেন। আলেমা হতে তার মাত্র ছয় বছর লেগেছে। মাদরাসায় পড়াকালীন হঠাৎ এক তরুণ শিক্ষকের প্রেমে পড়েন। ঝড়ের মতো বাধভাঙা প্রেম। পরিবারের প্রবল আপত্তি থাকা সত্ত্বেও কিছুদিনের মধ্যেই পালিয়ে বিয়ে করেন ওই শিক্ষককে। বিয়ের পনেরো দিন পরই জানতে পারেন ওই লোক বিবাহিত। এমনকি তার আগের স্ত্রী এখন প্র্যাগনেন্ট!

এই সত্য জানার পর আপা একটুও ভেঙে পড়েননি। ওই মাওলানার সঙ্গে দুর্ব্যবহারও করেননি। সন্ধ্যার সময় দেখা হলে তার চোখে চোখ রেখে ঠাণ্ডাগলায় শুধু বলেছিলেন, আপনাকে জীবনে আর কোনোদিন আমার সামনে না দেখলে খুশি হবো। আপনাকে দ্বিতীয়বার দেখলে আল্লাহর নামে কসম খেয়েছি- আপনাকে আমি খুন করবো!

এই ঘটনার পর ফাহমিদা আপা প্রতিজ্ঞা করেছেন, জীবনে আর বিয়ে করবেন না। তার পরিবার সব ভুলে তাকে আবার নতুন করে জীবন শুরু করার ব্যাপারে অনেক চাপ দিয়েছে, তিনি কিছুতেই রাজি হননি। বেশি জোরাজুরি করার কারণে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগও কমিয়ে দিয়েছেন। 

আলেমা হয়ে এ মাদরাসায় শিক্ষকতা করছেন তিন বছর। কারো সঙ্গে মেশেন না খুব একটা। নিজের মতো একলা থাকেন।

ফাহমিদা আপার জন্য এ কারণে খুব খারাপ লাগে মারুফার। ইশ, আপা যদি আবার বিয়ে করতো, কী সুখীই না হতো তার স্বামীটা। এমন ছেলে কি একজনও নেই বাংলাদেশে, যে ফাহমিদা আপার সব দুঃখ ভুলিয়ে দেবে? 

মারুফা খুব চায় ফাহমিদা আপা একটা বিয়ে করুক। হয়তো মাদরাসার সব মেয়েই চায় আপার খুব হ্যান্ডসাম দেখে একটা মাওলানার সঙ্গে বিয়ে হোক। কিন্তু আপা মনে মনে কী ভাবেন তা আল্লাহই মালুম।

কোনোদিন বিয়ে করবেন না, এমন প্রতিজ্ঞা করার কারণেই হয়তো একটা সন্তানের হাহাকার খুব অনুভব করেন ইদানীং ফাহমিদা আপা। একটা বয়সে সব মেয়ের মনেই হয়তো মাতৃত্বের প্রবল বাসনা জেগে ওঠে। তার সেই বয়সটা পার হয়ে যাচ্ছে।

আজকে পরের ক্লাসের শিক্ষিকা সুমাইয়া আপা নেই। ছুটিতে বাড়ি গেছেন। তার মানে আজকে ফাহমিদা আপার সঙ্গে পাক্কা এক ঘণ্টা গল্প করা যাবে। 

পড়ানো শেষ করেই ফাহমিদা আপা মারুফার দিকে তাকিয়ে বললেন, মারুফা, শরীরের কী অবস্থা এখন?

: জি, ভালো।

: কালকে আর বমি হয়েছিলো?

: না, আর হয়নি।

: আমি তোমার কথা যখনই ভাবি তখনই অবাক হই। মানুষ রাগ করে কতো অঘটন ঘটায়, কতো কিছু করে। কিন্তু তুমি খাও কাঁচামরিচ। এমন কাহিনি আমি জীবনেও শুনিনি।

আপার কথায় মারুফা লজ্জায় উড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো।

: ওরে... আবার লজ্জা পাচ্ছে! মরিচ যখন খাও তখন এই লজ্জা কোথায় থাকে শুনি? আজব একেকটা।

: আপা, জানেন না তো, আমাদের মাঝে একজনের আরও আজব স্বভাব আছে। পেছন থেকে বলে ওঠলো মারইয়াম।

: কী রকম আজব স্বভাব? কে সে?

: ওই যে আয়েশা। ওর মন খারাপ হলে ও ডিটারজেন্ট পাউডারের গন্ধ শুঁকে। ওর সঙ্গে সবসময় এক প্যাকেট হুইল পাওয়ার হোয়াইট থাকে।

ওর কথায় পুরো ক্লাসজুড়ে হাসির রোল পড়ে গেলো। ফাহমিদা আপাও হেসে ফেললেন।

: আয়েশা, সত্যি?

আয়েশা এমনিতেই লাজুক স্বভাবের, কারো সঙ্গে খুব একটা মেশে না। দারুণ লজ্জা পেলো ও। আমতা আমতা করে বললো, না আপা, ও এমনিই বলছে।

মারইয়াম হৈ হৈ করে ওঠলো, বিশ্বাস না হলে ওকে চেক করে দেখেন, ওর পাজামার পকেটে এখনও সম্ভবত এক প্যাকেট মধুর সুবাসিত হুইল পাউডার আছে। আরেক দফা হাসি!

চলতে লাগলো সবার আজব স্বভাবের ঠিকুজি উদ্ধারের পালা। একজন আরেকজনের আজব স্বভাবের বর্ণনা দিতে লাগলো প্রবল উৎসাহে। কে বালিশের নিচে মাথা রেখে ঘুমায়, কে ঘুমের মধ্যে হেঁটে হেঁটে আরেক রুমে চলে যায়, ছেলেদের দেখলেই কার পা কাঁপে- এমন আজগুবি সব কাণ্ডের কৌতুক চলতে লাগলো পুরো ক্লাসময়।

হঠাৎ ফাহমিদা আপার চোখ পড়লো মারুফার ওপর। ও কেমন যেন পিঠ টান করে বসে আছে। সারা মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছে। কোটর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে চোখ দুটো।

ফাহমিদা আপা ভয় পেয়ে গেলেন। বললেন, মারুফা, কী হয়েছে তোমার?

মারুফা কোনোরকম ঢোক গিলে বললো, আপা, বমি আসছে...।

: বসে আছো কেন, জলদি বাথরুমে যাও? এ্যাই জান্নাত, ওকে নিয়ে যাও তো!

জান্নাত ওকে ধরে তাড়াতাড়ি বাথরুমের দিকে নিয়ে গেলো। একটু পরেই বাথরুম থেকে ভারী কিছু পতনের শব্দ শোনা গেলো। জান্নাত দৌড়ে এসে বললো, আপা, মারুফা অজ্ঞান হয়ে বাথরুমে পড়ে গেছে!



০৪.

আড়াই মাস পর মাদরাসায় এসেছে মারুফা। মারুফা আসার সঙ্গে সঙ্গে পুরো মাদরাসায় খবর চলে গেলো। সব ক্লাসের ছাত্রীরা ওকে দেখতে এসেছে। ও ওর নিজের ক্লাসরুমে নিজের বেডের উপর বসে আছে। চারপাশে বান্ধবীরা। কারো মুখে কোনো কথা নেই। কী বলবে, কেউ কিছু বুঝে ওঠতে পারছে না।

ফাহমিদা আপা ওকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। মারুফার মাথায় এখন একটা চুলও নেই। সব ঝরে গেছে। গলায় ক্যান্সার হয়েছে ওর। থেরাপি চলছে, তবে ডাক্তাররা কোনো আশার বাণী শোনাতে পারেননি। ক্যান্সার লাস্ট স্টেজে পৌঁছে গেছে। এখন থেরাপি দিয়েও কোনো লাভ হবে না।

কয়েকদিন আগে হসপিটাল থেকে তাই ওকে বাড়ি নিয়ে এসেছে ওর পরিবার।

: জান্নাত কই মা? আজ প্রথমবার সবার সামনে ও ফাহমিদা আপাকে মা বলে ডাকলো। হয়তো ভালোবাসার শেষ চিহ্নটুকু রেখে যেতে চাচ্ছে। সবাইকে জানিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, এই দুঃখী আপাটাকে ও গোপনে মা বলে ডাকতো। একান্তে ও এই মায়ের সন্তান হয়ে স্বার্থপরের মতো আদর ভালোবাসা নিতো।এতোদিন পর মারুফার মুখে আবার মা ডাক শুনে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন ফাহমিদা আপা।

: মা, জান্নাত মাদরাসায় নেই? ও দেখা করবে না আমার সঙ্গে? ও কি আমার ওপর রাগ করে আছে?

এটুকু বলেই হাঁপিয়ে ওঠলো মারুফা। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। মুখ হা করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলো কিছুক্ষণ।

আপা চোখ মুছতে মুছতে বললেন, হ্যাঁ, মাদরাসায় আছে তো। মারইয়াম, দেখো তো জান্নাত কোথায়?



জান্নাত দু হাঁটুতে মুখ গুঁজে মাদরাসার ছাদে একা বসে আছে। মারইয়ামকে আসতে দেখেও নড়লো না।

: মারুফা তোকে ডাকছে, আয়!

: তুই যা মারইয়াম, আমি যাবো না।

: কী বলছিস? মারুফা কতোবার করে ডাকলো তোকে। ওকে একবার দেখবি না?

: আমার মনের মধ্যে যে উচ্ছ্বল, যে দুষ্টু চঞ্চল মারুফার ছবি আঁকা আছে, সেই মারুফাকে আমি মন থেকে মুছতে চাই না। আজ ওকে দেখলে ওর ক্যান্সার বিধ্বস্ত ছবিটা আমার মনের মধ্যে গেঁথে যাবে। আমি ওর এই ছবিটা মনের মধ্যে রাখতে চাই না। তুই যা!

: কিন্তু তাই বলে মারুফার ক্যান্সারকে তো তুই অস্বীকার করতে পারবি না। আয় আমার লক্ষী আপা। তোর প্রিয় বান্ধবীর শেষইচ্ছাটা কি তুই পূরণ করবি না? ও তোকে দেখতে চেয়েছে!

জান্নাত কিছু বলতে পারলো না। কান্নার গমকে শরীরটা দুলে ওঠতে লাগলো বারবার।



***

এই মারুফাকে চেনে না জান্নাত। সেই রাগী মারুফা শুকিয়ে এতোটুকুন হয়ে গেছে। চোখের চারপাশে বয়স্ক মানুষের মতো কালি পড়ে গেছে। হাত-পায়ে হাড়গুলো ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই। ফর্সা মুখটা কেমন হলদে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

মনে হচ্ছে, কতোদিন তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভীষণ ক্লান্ত ওর চোখ দুটো। চোখের দৃষ্টিতে সেই চেনা দৃষ্টি নেই, চিরচেনা উচ্ছ্বলতা নেই, সেই রাগ নেই; অভিমানী আহ্লাদি মারুফাটা কেমন যেন শুকনো পাতার মতো মিইয়ে গেছে।

ওকে দেখে জান্নাত নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না। ‘ওরে আমার মারুফা রে...’ বলেই ওকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো। মারুফার ঘোলাটে শুষ্ক চোখও অল্প অল্প ভিজে ওঠলো।দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে রইলো অনেকক্ষণ। মারইয়াম এসে জান্নাতের মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে সরিয়ে আনলো। 

মারুফার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। নিঃশ্বাসগুলো কেমন আটকে যাচ্ছে বুকের ভেতর। হৃদপিণ্ডের চেনা পথগুলোও আজ অচেনা মনে হচ্ছে। নিঃশ্বাসেরা পথ ভুলে গেছে আজ। বুকের মধ্যে খুব ব্যথা।

: ও আপু, কী খাওয়াবো তোমাকে আজকে আমি? কী খাবা তুমি বলো? তুমি তো আমার সঙ্গে রাগ করে মরিচ খেতে। ও মারুফা, মরিচ খাবি আপুনি?

মলিন একটা হাসি দিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো মারুফা। নিচের ঠোঁটটা একটু একটু কেঁপে ওঠলো, অভিমানে।

: এই দেখ, তুই আসবি শুনে আমি সুন্দর দেখে কত্তো মরিচ এনে রেখেছি! আজকে ভাত খাবি আমার সঙ্গে আপুনি? আমি তোকে মরিচ মেখে খাইয়ে দেবো। খাবি?

: জান্নাত, কী করছো তুমি? জানো না ও ভাত খেতে পারে না! ওর সামনে কীসব আবোল তাবোল বলছো?

জান্নাতকে বকা দিলেন ফাহমিদা আপা। আপার বকা শুনে ওর ছোট্ট হৃদয়টা দুমড়ে মুচড়ে গেলো। এতোদিনের জমানো ব্যথা, অভিমান, কষ্ট বুকের মধ্যে হু হু করে বেজে ওঠলো।

: কেন খাবে না? আমি কতোদিন ওর সঙ্গে ভাত খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছি। ওর জন্য ওর পছন্দের মরিচ জমিয়ে রেখেছি। আপা, আপনি একবার বলেন না ওকে আমার সঙ্গে ভাত খেতে। ও আপা, একবার... শুধু আজকে, আর কোনোদিন আপনার কাছে কিছু চাইবো না। আপা গো...! 

জান্নাত আর কিছু বলতে পারলো না, কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে। ফাহমিদা আপা এসে জান্নাতের পিঠে হাত রেখে সান্ত¡না দেয়ার চেষ্টা করলেন। ওর কান্না দেখে ক্লাসের সবার চোখে অশ্রুর প্লাবন দেখা দিলো।

মারুফার দু’চোখ বেয়ে নীরবে ঝরছে অশ্রুর ধারা। ফাহমিদা আপাকে বললো, আপা, ওকে একটু আমার কাছে আসতে বলেন। ও একটু আমার পাশে বসে থাকুক। এদিকে আয় জান্নাত, আমাকে একটু জড়িয়ে ধরে বোস আমার পাশে। আয় আপু...!

জান্নাত মারুফাকে বুকের খুব গভীরে জড়িয়ে ধরলো। এক বান্ধবী আরেক বান্ধবীকে বুকে আগলে নিয়ে বসে রইলো অশ্রুর বন্যার ভেতর। যেনো ক্যাঙ্গারু তার শাবককে পৃথিবীর সমস্ত মলিনতা থেকে বাঁচাতে আগলে রেখেছে নিজের চর্মগর্ভে।



০৫.

মারুফা মারা গেলো ভোরবেলা। 

ফজরের আজান হয়েছে কেবল, ভোরের পাখিরা জাগেনি এখনও। পূবের আকাশ নীলাভ হয়ে ঘোষণা করছে আরেকটি নতুন দিনের। মারুফা নামের এক প্রাণোচ্ছ্বল কিশোরী সে নতুন দিনটির আলো গায়ে জড়িয়ে নেওয়ার আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলো।

গতরাতে ফাহমিদা আপা মাদরাসা থেকে ওর সঙ্গে ওদের বাড়িতে এসেছিলেন। মারুফার মায়ের অনুরোধ ফেলতে পারেননি, রাতটা তাই ওর কাছে থেকে যান।

রাত তখন সাড়ে দশটা। ফাহমিদা আপা মারুফার মাথার কাছে বসে আছেন। সুরা মুলক পড়ছিলেন। এমন সময় মারুফার মুখটা নড়ে ওঠলো।

: আপা ভাত খেয়েছেন? আস্তে আস্তে অনেক কষ্ট করে ফাহমিদা আপাকে জিজ্ঞেস করলো মারুফা।

ফাহমিদা আপা মাথা নাড়লেন, খাননি।

: আপনি একটু আমার সামনে বসে কাঁচামরিচ মাখিয়ে এক প্লেট ভাত খাবেন? কতোদিন হয়ে গেলো আমি ভাত খেতে পারি না। আপনি আমার সামনে বসে ভাত খেলে মনে হয় আমিও ভাত খাওয়ার কিছুটা তৃপ্তি পাবো। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে আপনার ভাত খাওয়া দেখবো। 

ফাহমিদা আপা ওর কথা শুনে সহ্য করতে পারেননি। মুখে ওড়না চাপা দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন। একটু পর প্লেটে করে ভাত নিয়ে এসে ওর সামনে বসে খেয়েছেন। ভাতের প্লেটে টপটপ করে পড়ছিলো তার চোখের জল। তিনি চোখের জলমাখা ভাত বড় বড় নলা বানিয়ে গোগ্রাসে গিলছিলেন।

মারুফার শুকনো গাল বেয়েও অঝোরে ঝরছিলো অশ্রুধারা। গভীর আগ্রহ নিয়ে সে আপার ভাত খাওয়া দেখছিলো। কিছু বলতে পারছিলো না, কোনো শব্দও করেনি। শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে আপার খাওয়ার দৃশ্য দেখেছে।

ওভাবে নিঃশব্দে কেঁদে কেঁদেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো মারুফা। ঘুমের মধ্যে কখন চিরঘুমের দেশে চলে গেছে ছোট্ট মারুফা, কেউ জানতেই পারেনি। কাউকে না জানিয়েই সবার অলক্ষে চুপটি করে বিদায় নিয়েছে পৃথিবী থেকে।





পরিশিষ্ট

মাঝরাতে জেগে ওঠলাম। পাশে ঘুমানো জান্নাতের দিকে তাকিয়েই বুঝলাম, ও কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে। এমনটাই হয় বরাবর, ও দুঃস্বপ্ন দেখলে ওর আগে আমি জেগে ওঠি। আমি জেগে ওকে ডাক দেই।

জান্নাতকে ডাক দিলাম, পাখি, এ্যাই পাখি!

: উঁ...!

: কী হয়েছে? এই যে আমি!

: উঁউঁউঁ...!

ওর স্বপ্নটা এখনও শেষ হয়নি। চোখ পিটপিট করছে। স্বপ্নটা কি ওকে শেষ করতে দিবো নাকি আগেই জাগিয়ে তুলবো- এমন ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ধড়মর করে জেগে ওঠলো জান্নাত। ‘আপনে কই, আপনে কই...’ বলতে বলতে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

আমি অনেকক্ষণ ওকে বুকে নিয়ে বসে রইলাম। আমাদের বিয়ের এক বছর হলো। বিয়ের পর থেকেই দেখে আসছি, মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখার অভ্যাস আছে জান্নাতের। প্রথম প্রথম প্রায়ই দেখতো। আস্তে আস্তে সেটা কমে এসেছে এবং দুঃস্বপ্নগুলোও এখন আর ওকে খুব একটা কাবু করতে পারে না।

আমি ওর মাথার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে বললাম, আবার দুঃস্বপ্ন? আমাকে বলা যাবে?

: মারুফাকে স্বপ্নে দেখেছি।

: মারুফা কে?

: মাদরাসায় আমার বান্ধবী ছিলো। পাঁচ-ছয় বছর আগে, আমি তখন

Post a Comment

0 Comments