ইয়াসমীন।

ইয়াসমীন একটি গল্পের নাম

ইয়াসমীন এমন একটা গল্পের নাম – যে গল্পটা আমি চারবছর ধরে লিখছিও ছিড়ছি। এবং প্রতিবার ছিড়ে ফেলার পর অনুশোচিত হয়েছি। ইয়াসমীন এমন একটা গল্পের নাম – যার বীজ কখন আমার ভেতর প্রোথিত হয়েছিল – মনে নেই। কিংবা ইয়াসমীন কোনো সত্য গল্পের নাম, যা আমার কাছে বহুযুগ আগের কিন্তু স্পষ্ট কোনো স্মৃতির নাম। যেন সত্যিই ছিলো।প্রথমবার যখন গল্পটা লিখছিলাম – রোজ যতটুকু লিখতাম নাঈমাকে পড়ে শুনাতাম। তখন আমাদের এন্ড্রোয়েড ফোনসেট ছিলো না। প্রথমদিন একটানা বাইশ পাতা শুনিয়েছিলাম। সাধারণত একপাতায় তখন পঁয়ত্রিশ থেকে বিয়াল্লিশ লাইন লিখতাম।সাঁইত্রিশ পাতা লেখার পর ছিড়ে ফেলা সেই গল্পটার জন্য আমার দুঃখ হয়।
এরপর আরও তিনবার লিখেও সেই প্রথমবারের মত না হবার কারণে ছিড়ে ফেলেছি।
তবু, এই আমার শেষ চেষ্টা।
আমি জানি, আরও তিরিশবার লিখলেও হবে না। যার কারণে ছিড়ে ছিলাম প্রথমবার, তার অনুরোধ ছিলো আবার লেখার। কিন্তু সুর কেটে গেলে কিছুই অার বাজেনা ঠিকঠাক।
তবে সেটা আমার গল্পের প্রথম তিনজন শ্রোতার জন্য – যাদের নাঈমা গল্পটা অর্ধেক বলে আটকে রেখেছে।


ক্যালেন্ডারের পাতায় তারিখের বদল হয়েছে ঘণ্টাখানেক আগে। মধ্যরাত এখন প্রায়।এই উপশহরে সাড়ে বারোটা মানে গভীর রাত। ছাদে বসে আছি। শীতল পাটিতে, হাঁটুতে মুখ গুঁজে। আমার সামনে পরে আছে একটা মুখবন্ধ খাম। গাঢ় নীল রঙের খামে রুপালী অক্ষরে আমার নাম লেখা। কোনো ঠিকানা নেই। অতি পরিচিত হাতের লেখা, মুক্তোর মত হরফগুলো যেন আমার দিকে চেয়ে হাসছে। খামের বর্ডারগুলো সোনালী। প্রেরকের নামের জায়গায় একথোকা জুঁইফুল। ইয়াসমীন। একঘণ্টা ধরে আমি এই খামটার দিকে তাকিয়ে আছি। খোলার সাহস হচ্ছে না। আমি জানিনা কী আছে এই খামে লেখা। ফাল্গুনের দ্বাদশ রাতে চাঁদ আকাশে। অদূরে কীর্তনখোলা নদী চাঁদে বুকে নিয়ে বসন্ত বাতাসে উতলা ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভাঙছে নিরবতা। আমার সমুদ্রের কথা মনে পড়ছে। আমার একবার সমুদ্রের কাছে যাবার কথা ছিলো। এমন রাতে। মাতাল হাওয়ায় উন্মাতাল সমুদ্রে যখন ঢেউয়ে ঢেউয়ে গলে যাবে পূর্ণ চন্দ্রের আলো – তেমন রাতে। বালুকাবেলায় খালি পায়ের ছাপ একে আমি গিয়ে দাঁড়াব সমুদ্রের কাছে। তারপর দু পা জলে ডুবিয়ে হাঁটুতে মুখ রেখে জানতে চাইব সমুদ্রের গোপন কথা। কিসের এত কান্নার লোনা জলে অনন্তকাল ভরে আছে তোমার বুক! আমাকে বলো দেখি তুমি। আমার কষ্টের চেয়ে বেশি দুঃখ তুমি বহন করো প্রিয়? কোন কান্নায় তুমি হাজার বছর ধরে উথলে আছড়ে পড়ছো! আমার পায়ের ওপর তখন মাথাকুটে মরবে সমুদ্দুর, বলবে বোলো না তোমার কষ্টের কথা – আমি আর দুঃখ পেতে চাই না। আমি দু হাতে ছুঁয়ে দেব সমুদ্রকে, আমার আজন্মের তিয়াস জানি সমুদ্দুরও মেটাতে পারবে না। কোথা থেকে কোথায় চলে আসলাম! ছাদে ফিরে যাই। আমার সামনে ছাদের ঠিক মাঝখানে বৃত্তাকারে সাজানো কতগুলো গোলাপের টব। বাহারীসব গোলাপ ফুটে আছে। স্বাভাবিকের চেয়ে বড় আকারের সব গোলাপ। গোলাপের ঘ্রাণে আমি ঘোরগ্রস্ত হয়ে আছি।না গুণেও ঠিক বলে দিতে পারি ওখানে পঁচিশটা টব আছে।
আজ আমার পঁচিশতম জন্মদিন।
বৃত্তের বাইরে, বড় আকারের টবে একটা গাছ। জুঁই। আমি জানিনা, জুঁই কোন মৌসুমের ফু্ল, তবে শাদা শাদা ফুল চাঁদের আলোতে অপার্থিব রূপকল্প তৈরি করছে।
এই মধ্যরাতে আমার ছাদে থাকার কথা না।
তবু আমি এসেছি । ছেলে মেয়ে ঘুমিয়ে আছে ঘরে। ওদের বাবা বাড়ি নেই, গ্রামে গেছেন। বিকেলের কথা মনে করলাম।
আজ দুপুরের পর খেয়ে দেয়ে শুয়েছিলাম মুহাম্মাদকে নিয়ে। গল্প শুনতে শুনতে ও ঘুমিয়ে পড়লে আমি লিখতে বসলাম। নিঝুম দুপুর। শীতের জড়তা এখনও ঠিক কাটেনি, তবে বাতাসের গতি ঘুরে গেছে। দোতলার দখিনের জানালায় নারকেল পাতা ঝাপটাচ্ছে, যেন বাতাস করছে। একটু দূরে নদী থেকে বেয়ে আসা ছোট খালের পাড়ে হিজল গাছ, কদিন পরেই ফুল উৎসব শুরু হবে। কৃষ্ণচূড়াও সেজে উঠছে, কলিতে ভরে যাচ্ছে গাছটা। সোনালুও ঝুলিয়ে দিচ্ছে কলি ভরা লম্বা লম্বা ডাঁটা, একটা দুটো করে ফুটছে। নবীন গাছগুলের ভেতর একটা নীরব প্রতিযোগিতা চলছে যেন, কারচে কে বেশি ফুলসাজে সাজতে পারে। এসব দেখছি আর আনমনা হচ্ছি। এমন সময় কলিং বেলের টুংটাং শব্দ ছড়িয়ে পড়ল সারা ঘরময়। আমি একটু অবাক হলাম। এসময়ে সাধারণত কারও আসার কথা নয়।
নদী পেরিয়ে শহরের বাইরে নদীর তীর ঘেষে আমাদের বাড়ী। দোতলা ছোট্ট ঘর, সামনে পেছনে বেশ খানিকটা করে খোলা জায়গা, খাল কেটে আনা ছোট্ট খাল। বাহারী সব ফল আর ফুলের গাছ চারপাশে। সবজি বাগান। আর একঝাঁক কবুতর নিয়ে আমার বসবাস। রোজ সকালে নদী পার হয়ে মেয়ে চলে যায় মাদরাসায়। ওর বাবা তার কাজে। আমি অার ছেলে সারাদিন একলা। আম্মুর সাথে সপ্তাহে একবার গিয়ে দেখা করে আসি। আম্মুও মাঝে মাঝে আসেন, তবে সেটা সকালে। সারাদিন থেকে চলে যান। আর সারাদিন নিজের ভেতর ডুবে থাকা আমার আশেপাশের কারও সাথে খুব সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। তাই এই অসময়ের টুংটাং আমাকে অবাক করল। ভাবতে ভাবতে আবারও ছোট চাপ পড়ল বেলে। অপরিচিত ঢংয়ে বেল বাজাচ্ছে, যেন কিছুটা ইতস্তত ভাব। ভাবলাম – যেই আসুক নতুন মেহমান, যে আর কখনও আসেনি। সিঁড়ি বেয়ে যখন নামছিলাম, তখন আমার কল্পনাতেও আসেনি কে এসেছে। দরজা খুলে আমি একটু অবাক হয়েই তাকিয়ে রইলাম। ঠিক তাহীয়া ও মুহাম্মাদের বয়সী দুটো ছেলে মেয়ে, একটু ছোটও হতে পারে।

কালো বোরকা হিজাব পরা ছোট্ট পরীর মত মেয়েটি আমাকে সালাম দিল। যেন রিনরিন করে উঠল চারপাশ। আমার কী যেন মনে পড়ি পড়ি করেও পড়ছে না। খুব চেনা কিন্তু অচেনা। আমি সালামের জবাবও দিতে পারছিলাম না।
পরীটি বলে উঠল – খালামণি! আমি তাসনীম, সাবিহা তাসনীম। আর ও আদনান।
পাশ থেকে ছোট্ট পুতুলের মত ছেলেটি বলল, আদদান উবায়দী।
মুহুর্তে আমার মাথা কাজ করল।
আমি দরজা ছেড়ে দাঁড়ালাম।
তারপর অস্ফুটে বললাম, এসো।
– কার সাথে এসেছো?
– আব্বু। বাইরে আছেন।
দূরে, বাউন্ডারি দেয়ালের গেটের ওপাশে একটি দীর্ঘ সাদা অবয়ব চোখে পড়ল আমার। একটু কি ভয় পেলাম? শীতল শিহরণ বয়ে গেল মেরুদন্ড দিয়ে। পরক্ষণে ওদের দিকে নজর ফেরাতেই ভয়টা চলে গেল। আদনানের হাত ধরে বললাম – ভেতরে আসো বাবা। মায়ের মতই নিঃশব্দে সিড়ি বেয়ে উঠে এল দুজনে। বসার ঘরের সোফায় বসে এবার জানতে চাইলাম
– কোথা থেকে এসেছো?
– বাড়ি থেকেই।
– আম্মু কই? সে আসেনি কেন?
এক মুহুর্ত দ্বিধা কিংবা বেদনার ছায়া কি পড়ল নীলাভ চোখে? বুঝতে পারার আগেই জবাব দিল পরীটি – বাড়িতে আছেন।
অামার প্রশ্নভরা দৃষ্টি দেখে পরের কথাটা নিজে থেকেই বলল তাসনীম – আমরা আপনাকে দেখতে এসেছি, বেড়াতে এসেছি।
কী যে হলো আমার – চোখে জল এসে গেল। তারপর দুজনার সাথে বেশ খানিকটা সুন্দর সময় কাটালাম। তাসনীম সেলফ থেকে বেছে বেছে বই নিলো, প্রায় বইই তাহীয়ার গল্পের বই – বলল ফেরত দিয়ে যাব খালামণি! আমি সবগুলোই ওকে দিয়ে দিলাম। বললাম, বই দিতে নয় – বইয়ের মালিকের সাথে দেখা করতে একদিন এসো ফের।
আদনানকে দিলাম রঙ তুলি। ছবি আঁকা ব্যাপারটা ও ঠিক বুঝছিলো না। ওকে নিয়ে রঙ মাখামাখি করলাম। ওর শাদা পানজাবিতে রঙিন ছোপ লেগে গেল। তবু ও খুশি খুব। ঝটপট হালুয়া বানিয়ে ফেললাম ঘী আর সুজি দিয়ে।
অবশ্য ওর মায়ের রাজকীয় হালুয়ার সামনে এটা লজেন্স বই কিছু নয়, তবু ওরা খেলো। আমি তৃপ্তি নিয়ে ওদের সাথের সময়টা উপভোগ করলাম। কিন্তু একটু অভিমান হচ্ছিলো ওদের মা না আসায়।
অভিমানটুকু বুকেই রইলো।
তাসনীম মাদরাসায় পড়ে, তৃতীয় শ্রেণীতে। বাসায় বাবার কাছে কুরআন হেফজ করে। আর চার বছরের আদনান এখনও উড়ন্ত!
কত যে গল্প দুজনার। মনেই হয়না এই প্রথম এলো। মায়ের কাছে আমার সম্পর্কে জেনে, ও শুনে শুনে যেন নিজের আপন খালামণির মত লাগছে ওদের! আমিও মধুর স্মৃতিচারণ করলাম।
একটা সময় চমকে উঠে তাসনীম বললো – আব্বু ডাকছেন! যেতে হবে।
আমার মনটা বিষাদে ছেয়ে গেলো।
আদনান ও মুহাম্মাদের ততক্ষণে জমে গেছে বেশ। আদনান পকেট থেকে ঝকমকে মার্বেল বের করে দিলো মুহাম্মাদকে। মুহাম্মাদ তার অতিপ্রিয় খেলনা প্লেনটা দিলো।
দুজনে চলে গেল। বাউন্ডারি গেট পর্যন্ত গিয়ে তাসনীম পেছনে ফিরলো, ঘুরে দাঁড়িয়ে একটু ফিসফিসিয়ে বললো – খালামণি! রাতে, বারোটার পর। ছাদে থাকবেন।
ঠিক সেই কন্ঠস্বর যেন আমায় ছুঁয়ে গেল!
ইয়াসমীন!
আমি চমকে উঠলাম, কাল একুশে ফেব্রুয়ারী । যতক্ষণে চমক ভাঙল ততক্ষণে ওরা চলে গেছে…।
সন্ধে তখন হবো হবো করছে । ছাদে এসে ঝাড়ু দিলাম খুব করে। ধূপ জ্বাললাম। তারপর শীতলপাটি বিছিয়ে রেখে চলে গিয়েছিলাম। তাহী আসল সন্ধের সময়। দুজনকে রাতে জলদি খাইয়ে পৌনে বারোটার এলার্ম দিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুম এলো না, তবু তন্দ্রার মত সময়টা কাটিয়ে ছাদে আসলাম। তারপর থেকে এই বসে থাকা…।

শেষবার ইয়াসমীনের সাথে আমার দেখা হয়েছিল গত বৈশাখে। সেদিন পূর্ণিমা ছিলো। ঢাকা থেকে বরিশাল ফিরছি।
গভীর রাতে, লঞ্চের ব্যালকনী জনশূন্য।কেবিনের টিভিগুলো থেমে গেছে। দুয়েকজন ধূমপায়ী সিগারেট ফুঁকছে হেঁটে হেঁটে। সামনের ডেকে কেউ চায়না মোবাইলে গান বাজাচ্ছে।
এয়ারফোনের এককানে কালামে ইকবাল শুনছি। নদীতে তখন আগুন লেগে গেছে। চান্দের আগুন।আগুন ছড়িয়ে যাচ্ছে ঢেউয়ে ঢেউয়ে। বৈশাখের নদীতে স্রোত। বড় বড় ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ যেন প্রাণে শিহরণ তোলে। শবনম মাজীদ গাইছেন,” তু মেরি রাত কো মেহতাব সে না মাহরুম রাখখো. . “।
হঠাৎ আমি একটা পরিচিত ঘ্রাণ পেলাম। আমার অবচেতন মন আচমকা চিনতে পারছিলো না। ভ্রু কঁুচকে এদিক ওদিক চাইতেই দেখি বোরকা পরা কেউ এদিকে আসছে। চার পাঁচ হাত দূরে থাকতেই আমি নিঃশব্দ হাঁটার ভঙ্গি দেখে চিনে ফেললাম। কিন্তু কিসে যেন আমাকে আটকে রাখলো! আমি চুপ হয়ে থাকলাম। আমাকে অতিক্রম করে চলে গেল সে। চার পাঁচ কদম এগিয়ে গিয়ে ঘুরে ফেরত আসলো। এই হাঁটা বা পেছনে ঘুরে আসা সবই আমার চেনা।
– মারজান! তুমি এখানে?!
– হু, তুমি? কোথায় যাচ্ছো?
– যাচ্ছি তো বরিশাল। বহুকাল তোমার সাথে দেখা নেই, তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম । বেড়াতে। এভাবেই দেখা হয়ে গেলো।
আমি ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছি। ও আমার হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে বরাবর সামনের চেয়ারে বসলো। আমরা কথা হারিয়ে ফেললাম। একটু পর জানতে চাইলাম
– কার সাথে যাচ্ছো?
– আদনানের বাবার সাথে। তবে দেখা তো হয়েই গেলো, আর যাবো না। সকালেই ফিরে যাবো বাড়িতে। তাসনীম আর আদনানকে রেখে এসেছি।
বরাবরের মতই এই লুকোচুরিটুকু উপভোগ করলাম আমি।
সম্ভবত ইয়াসমীনও। নেকাব খুলে নদীর দিক মুখ করে বসল ও। তারপর ওর ঢাউস হাতব্যাগ খুলে বের করলো ফুলের তোড়া। প্রায় পদ্মফুল আকারের গোলাপ আর নানা রঙের বুনোফুলের তৈরি তোড়া। অধিকাংশেরই নাম জানিনা। অদ্ভুত মাদকতায় ছেয়ে গেলো চারপাশ। আচমকা এত রাতে ফুলগুচ্ছ আমাকে আনন্দিত ও অভিভূত করলো। তবে আমি তোড়াটা নিলাম না।
– এত কম কেন গোলাপ! মাত্র তিনটে। আমি নেবনা।
– আরেহ, বড় তোড়া কী নিয়ে আসা যায়। ঝামেলার। পরে দেব তোমাকে। অনেক গুলো। গাছই এনে দেব পাহাড়ের।
এবার খুশী হয়ে নিলাম।

রাতে খেয়েছো?
অনুচ্চ কন্ঠস্বর তবু যেন রিনরিন করে উঠলো। আজ রাতে খাওয়া হয়নি। লঞ্চে সবসময় খাবার মুড থাকেনা। সেকথা ওকে বললাম। হেসে উঠে দাঁড়ালো, নেকাব বাঁধতে বাঁধতে যেন উড়ে চলে গেল, সেই শব্দহীন। কি করবো ভাবছি, ভাবতে ভাবতে মিনিট দুইয়ের মাথায় হাজির ফের। করিডোরের শেষ মাথায় দেখা যাচ্ছে দীর্ঘ, সফেদ পোশাকের একটি অবয়ব। প্রশ্নবোধক দৃষ্টি দেখে ইয়াসমীনও সেদিকে চেয়ে হাসলো। “সর্দার মশায় “। আমার অস্বস্তিবোধটুকু ওর চোখ এড়ালো না। হেসে ফেলল।
ভয় নেই, উনি এদিকে আসবেন না।
ওর হাতে দুই বাটির ছোট্ট টিফিন কৌটো। চাঁদের আলোতে রুপো ঝকঝক করছে। কোলের ওপর বাটি রেখে খুলল প্রথমে। বাটির ঢাকনা ছোট প্লেটের মত। হালুয়া ও মিষ্টি বের করে সাজালো। তারপর আমার হাতে ধরিয়ে বলল
খাও।
আমি জানি না বলে লাভ নেই। তাছাড়া ওদের বাড়ির হালুয়ার লোভ সামলানো আমার মত চরম মিষ্টি অপছন্দকারীরও সম্ভব না। আর মিষ্টি তো অমৃতসম। রুপোর ঢাকনা, তাতে স্বর্ণের কারুকাজ। ছোট্ট এই টিফিনবক্সটি ওর সাথে পরিচয়ের প্রথমদিন হতে দেখেছি। ওর বাবা সখ করে বানিয়ে দিয়েছেন মেয়ের জন্য। ওর প্রায় জিনিসেই রুপোর কাজ থাকত, তবে ও সেটা কাউকে বলতো না। সবাই ভাবত স্টিল। এই যেমন এই বক্সটাকে সবাই ভাবত কাঁসার ওপর পেতলের কাজ। আমি জানতাম ওর বাকসের খবর। ঠান্ডা ঢাকনাটা হাতে নিলাম, ও পরোটা ছিড়ে টুকরো করে দিলো। ঘিয়ে ভাজা পরোটা। ইষৎ গরম। খেতে খেতে জানতে চাইলাম
এতবছর পর?
আরে, রাজার ছেলের সাথে বিয়ে হলে এমনই হয়। উনি তো সারাদিনই রাজকর্মে ব্যস্ত। আর রাজার বউদের একা কোথাও যাবার নিয়ম নেই। এখন বোঝো! আমি হাসলাম। ইয়াসমীনও। ওর চেহারা কেমন পান্ডুর দেখাচ্ছে। একটু কী ক্লান্তও?
তারপর টুকটাক গল্প, চুপচাপ বসে থাকা কতক্ষণ। আবু মুহাম্মাদ বের হয়ে এলেন একসময় আমার খোঁজে। আসছি বলে পাঠিয়ে দিলাম। অনুচ্চ স্বরে ছোটখাটো একটা ধমক দিলেন। আমি হজম করে ফেললাম। তারপর ইয়ামীন ও আমি দুজনেই হেসে ফেললাম।
বললাম – সর্দারজীও তো ধমক দেবেন একচোট – নাকি?
নাহ, তোমাদের বাসাতক যেতে হবেনা, পথেই দেখা হয়ে গেল, একদিন বেচে যাবার খুশিতে কিছু বলবে না আর।
নিঃশব্দ হাসিতে যেন ভেঙে পড়লো ও।
তারপর মাঝ রাত পেরিয়ে যাবার পর চলে গিয়েছিলো ও। যাবার সময় কিছু যেন বলতে গিয়েও বলেনি। আমার হাতে আগে থেকেই থাকা রুপোর গোলাকার আঙটি খুলে ওর হাতে দিয়েছিলাম। নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে বিনাবাক্য ব্যয়ে মধ্যমায় পরে নিয়েছিলো ও। আমি একটু অবাকই হয়েছিলাম। তারপর আর খবর নেই বহুদিন। আজকের এই চিঠি।
ইয়াসমীনের দেয়া প্রথম ও একমাত্র চিঠি। ওর কোনো যোগাযোগের ঠিকানা নেই আমার কাছে। এই প্রযুক্তির যুগেও নেই কোনো ই – ঠিকানা। আমিই কি কখনও চেয়েছিলাম? মনে পড়ে না। যখন ওদের বাড়িতে গেলাম – তখনও ঠিকানার কথা মনে হয়নি। একটু বিরক্তই হলাম নিজের ওপর। কী এমন হতো চাইলে!
উঠে গিয়ে গোলাপের পাশে বসলাম হাঁটু গেড়ে। হলুদ গোলাপ। পাশেরটা শাদা। চাঁদের আলোয় অপার্থিব কোনো ফুল মনে হচ্ছে। বুঝিবা স্বর্গের। খামটা হাতে নিয়ে মুখটা খোলার চেষ্টা করলাম। সহজেই ছুটে গেল আঠা। চারভাঁজ করা পৃষ্ঠাটা পরে গেলো কোলের ওপর। দ্বিধা হচ্ছে খুলতে, কিছুটা ভয়ও কী করছে…। সম্ভবত। আমি জানিনা।
আচ্ছা, ইয়াসমীনের সাথে আমার কবে দেখা হয়েছিলো প্রথম?
আমার আজও মনে আছে খুব স্পষ্ট করে।
তেরবছর আগের কথা। তখন মিজান জামাতে পড়ি। ক্লাস চলছে। দু টো ক্লাস হয়ে গেছে, তৃতীয় ঘণ্টা। জবরদস্ত মাদারীপুরেরর আপা এখনও আসেন নি, তারীখুল ইসলাম কিতাব পড়ান তিনি। ঘাড়ত্যাড়া আমার তার বেতের সাথে বেশ দোস্তি জমে গেছে। সেদিনও পড়া শেখা হয়নি আমার। আপার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে থামের আড়ালে শেষবেঞ্চে সাইমুম সিরিজের বই খুলে পড়া শুরু করেছি। আপা কখন আসলেন আর হাজিরা ডাকছেন – শুনতে পাইনি। কারণ তখন আমি মধ্যএশিয়ায় উজি কারাবাইন নিয়ে ব্যস্ত। তিনবার ডাকার পরেও যখন হাজিরা দিতে পারলাম না, তখন আপা উঠে আসলেন। বইসমেত আমাকে পাকড়াও করে বই বাজেয়াপ্ত করে আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ফের আসনে বসে আমার দন্ড ঘোষণা করার মুহুর্তে দরজায় একটা ছায়া পড়ল। তারপর কালো বোরকায় ঢাকা একটা অবয়ব দেখা গেলো। নিচু আওয়াজে সালাম শোনা গেলো। ফের তীক্ষ্ণ কন্ঠে আওয়াজ এলো – ভেতরে আসতে পারি?
আপা অনুমতি দিয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালেন।
– আমি মিজান জামাতে ভর্তি হয়ে এসেছি।
এখানে আসতে বলেছেন বড় আপা।
আপা নাম জানতে চাইলেন।
– সুরাইয়া ইয়াসমীন।
– আবাসিক না অনাবাসিক?
– অনাবাসিক।
– আচ্ছা, বসে পড়ো কারও পাশে।
অাপা আমাদের ওকে বসার জায়গা করে দিতে বললেন।
বিয়াল্লিশজন ছাত্রীর অনেকেই চাইছে নতুন ছাত্রীটা তার পাশে বসুক। বিব্রতভাব নিয়ে দাঁড়ানো আমি একলা শেষবেঞ্চে নিশ্চিত এখানে আসবে না।
কিন্তু নিয়ম ভেঙে সবাইকে পেছনে রেখে সে এসে আমার বেঞ্চে এসে বসলো। পুরো বেঞ্চ জুড়ে আমার বইখাতা ছড়ানো ছিটানো। সে
একপাশ দখল করে বসে পড়লো। আমি নির্বিকারভাবে চাইলাম। ঠান্ডা চোখে ঈষৎ বিরক্তির ছাপ কি ছিলো? সেও একইভাবে আমার দৃষ্টি ফিরিয়ে দিলো। বরং কার দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিলো, আমিই দৃষ্টিনত করে ফেললাম।
নিয়মের বাইরে আপা আমাকে না মেরে অন্য শাস্তি দিলেন। আমি থতমত খেয়ে গেলাম। কানধরে পুরো ক্লাসরুম তিনচক্কর দেবার চে শতবার বেত্রাঘাত বরং আমার কাছে সহনীয় ছিলো।
প্রতিবাদ করলে সাজার মাত্রা বাড়বে, বাড়বে সবার কৌতূহল।
সহপাঠীদের হাসিমুখগুলোর দিকে চেয়ে আমিও একটা বোকামার্কা হাসি দিয়ে শুরু করলাম। দেড়চক্করে এসে বেঞ্চে পা বেঁধে পড়ে গেলাম। কতটা ইচ্ছাকৃত আর কতটা সত্যিই পড়েছিলাম তা এখন আর মনে নেই। তবে পায়ে ব্যাথা পেয়েছিলাম খুব। খোঁড়াতে খোঁড়াতে উঠে দাঁড়িয়ে ফের শুরু করতে যাব, আপা অপ্রস্তুত কন্ঠে বললেন জায়গায় গিয়ে বসতে।
হাঁটু আর হাড় ডলতে ডলতে গিয়ে বসলাম।
থামের আড়ালে মাথাগুঁজে ক্লাস পার করে দিলাম। পরের ঘণ্টায় বড় আপার এসো আরবী শিখি ক্লাস। এই ঘণ্টার তামরিন নিয়মিত না লেখার দায়ে বড় আপার মোটা বেতের আদর আমার নিয়মিত প্রাপ্য হয়ে গেছিলো। এখনও ডান হাতের তালুতে নীলচে ছাপ পাওয়া যেতে পারে।
বড়আপা এলেন।
বই খুলে বসে আছি।
পাশ থেকে নতুন ছাত্রীর মৃদুকন্ঠে প্রশ্ন – পড়া কোথায়?
রাগে আমার শরীর জ্বলে উঠলো।
– আমি জানিনা।
– জানোনা তবে বের করেছো কীভাবে?
– এমনি খুলে রেখেছি। আর কারও কাছে জিগেশ করো।
আমাদের কথোপকথন শুনে সামনের বেঞ্চ থেকে সীরাজুম মুনিরা ঘাড় ঘুরিয়ে নতুন ছাত্রীর পড়া বের করে দিলো।
আমি তখন আহমদ মুসার পরবর্তী অবস্থা নিয়ে চিন্তিত। আপার থেকে বই উদ্ধারের কৌশল রচনায় ব্যস্ত।
নতুন ছাত্রীটি যার নাম সুরাইয়া ইয়াসমীন, পরবর্তীতে যাকে সবাই সুরাইয়া ও আমি ইয়াসমীন বলে ডাকতাম – সে ঝুঁকে এসে আমার বইয়ের পড়া ঠিক জায়গায় বের করে দিলো। আমি ভ্রু কুঁচকে বইটা ঝপ করে বন্ধ করে দিলাম।
বেচারী আমার থেকে এমন শীতল অভ্যর্থনা অাশা করেনি। সামনের দুতিন বেঞ্চ থেকে ওকে ডাকছে ওদের কাছে বসতে।
ওর চেহারার আভিজাত্য, পোশাকের পারিপাট্য ও আচরণের সৌন্দর্য ও উচ্চারণের শুদ্ধতা সবার নজর কাড়ছিলো। শুধু আমিই ছিলাম বেপরোয়া।
আমি চাচ্ছিলাম মেয়েটা উঠে যাক, আমার একবেঞ্চ নিয়ে আমি একা বসবাস করি, তা আর হলো না। ইয়াসমীন গেলোনা। আমাকে ও সবাইকে হতাশ করে বললো – আমি এখানেই বসছি।
মাথা নিচু করে আমি যখন ছালবাকল উঠে যাওয়া পায়ের ব্যাথায় দাঁত চেপে ম্যাসাজ করছিলাম, তখন সে তার তীক্ষ্ণ নাকটি আবার গলিয়ে দিলো।
– তোমার পায়ে খুব বেশি ব্যাথা করছে?
বারো বছর বয়সে আমার ভেতর একধরণের ঔদ্ধত্য ছিলো, তাই আমি অকপটে ব্যাথার করা স্বীকার না করে চুপ রইলাম।
– তোমার নাম কী? কথা বলছো না কেন?
আমি এবারও চুপ।
মেয়েটা ব্যাগ হাতড়ে একটা ছোট্ট কৌটা বের করলো। রুপোর ছিলো সেটা। খুলে বেঞ্চের নিচ দিয়ে আমার পাশে রাখলো।
– ব্যাথার জায়গায় লাগাও। সেরে যাবে।
প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে এবার আমি চাইলাম এই অনাহুত দরদীর দিকে।
ইয়াসমীন শীতলভাবে সে দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়ে নিচুস্বরে আমাকে ধমক দিলো – এই মেয়ে! এত ত্যাড়ামি করো কেন? যা বলছি করো।
সত্যি বলছি, ওর কন্ঠস্বরে কী একটা ছিলো, আমি আস্তে করে মলমটা নিয়ে প্রথমে পায়ে , হাঁটুতে ও পরে কনুইয়ে লাগালাম।
কালচে নীল মলমের ঝাঁঝে আমার চোখে পানি চলে এলো।
ইয়া মাবুদ! মিনিটখানেক পর এমন জ্বলুনি উঠলো, আমার যেন কান দিয়ে ধোঁয়া বের হতে লাগলো।
কটমট করে তাকিয়ে দেখি ইয়াসমীন বইয়ের দিকে চেয়ে মিটমিট করে হাসছে।
ধুত্তোর ভদ্রতার চৌদ্দটা বাজিয়ে আমি বললাম – ওঠো! এই বেঞ্চ থেকে উঠে সামনে যাও। আর যদি জীবনে আমার বেঞ্চে আসছো তোমার খবর আছে।
কিছু হলো না তার, যেন শুনেই নি।
বড়আপা ক্লাসে না থাকলে আমি ওরে ঘাড় ধরেই উঠিয়ে দিতাম।
এমন সময় বড়আপা ওকে ডাকলেন।
কার পাশে বসেছে খবর নিলেন, তারপর আমাকে দাঁড় ককরিয়ে বললেন ওকে পড়া বুঝিয়ে দিতে।
ইয়াসমীন ফিক করে হেসে ফেললো সবকটা দাঁত বের করে। আর নিজেই পড়ার খবর না রাখা আমি মনে মনে ইয়াসমীনের চৌদ্দগোষ্ঠীর সবার ফাতেহা পড়তে পড়তে হাসি হাসি মুখ করে জ্বী আপা বলে বসে পড়লাম।
আর তখনই অবাক হয়ে টের পেলাম আমার পায়ের হাঁটুর ব্যাথা ভালো হয়ে গেছে!

ক্লাসে ঢুকবার পর থেকে এই প্রথম আমি তার দিকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকালাম। প্রথমেই দৃষ্টি কাড়ল নীলচে চোখ। চোখে চোখ পড়তে হাসলাম। ইয়াসমীনও স্বস্তি পেলো।
সেদিন আর কোনো ঝামেলা ছাড়াই গেলো।
ক্লাস শেষ হতে ও চলে গেলো।
পরদিন ক্লাস শুরু হবার আগেই চলে এলো। আমরা তখন বেঞ্চ বিছিয়ে বসিনি। ও আসলো। নিজেই ব্যলকনী থেকে বেঞ্চ এনে সোজা পেছনে চলে এলো। সবার পেছনে অর্থাৎ আমার বেঞ্চটি ঠিক করে আগের দিনের মতো বসে পড়লো। আমি কেবল ঘুম থেকে উঠেছি, ভাত খাবো কি খাবোনা ভাবতে ক্লাসের ঘণ্টা বেজে গেলো।
প্রথম ঘণ্টা ইলমুছ ছরফ। সব পড়া নিয়ে চালবাজি চললেও এই ঘণ্টায় সেটা করবার কোনো উপায় বা ইচ্ছা আমার ছিলো না।
রাজাপুরের আপার সাথে ত্যাড়ামি করার মত সাহস আমার এই বয়সেও জন্মায়নি।
এখনও তার ফোন এলেও আমি বসে কথা বলতে পারিনা। তাঁর পড়াটা আমি ঠিকমত আদায় করতাম, প্রথমঘণ্টায় প্রথমবেঞ্চে বসতাম গিয়ে। পরীক্ষার খাতায় একশ নম্বরের উত্তর দিতাম। তারপরও যখন প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় একটা নুকতা গড়মিলে একনম্বর কম পেলাম একশর চে – তিনি আমাকে দশটি পিটুনি লাগিয়েছিলেন। অবশ্য তাঁর মারে ব্যাথা ছিলো না, তবে লজ্জা ছিলো। শরহে বেকায়ার বছর ” ভুল ” বানানে ভুল করার দায়ে কানে ধরে ওঠবস করার লজ্জা আমার আজও যায়নি। তাই তাঁর সাথে হিসেব করে চলা ছাড়া উপায় ছিলো না।
তো – সেদিন ইয়াসমীনকে রেখে প্রথমবেঞ্চে যেতে আমার খারাপ লাগছিলো, গেলাম না।
আপা এসেই আমাকে সামনে না দেখে খুঁজলেন। এবং উঠে না যাবার কারণ সম্ভবত তিনিও বুঝতে পেরে আর সামনে ডাকলেন না।
তো সেইদিন থেকে শুরু হলো আমার অশান্তির দিন। ক্লাসে বই পড়লে টেনে নিয়ে নিজের ব্যাগে রেখে দিতো। প্রতিটা ক্লাসে পড়া ধরতে বাধ্য করতো আমাকে। মাঝে মাঝে আমি খুব বিরক্ত হতাম। আমার বিরক্তির থোড়াই কেয়ার করতো সে।
আমাকে পড়া শিখতে বাধ্য করার একটা কিতাব নিয়ে এসে আমার কাছে পড়া বুঝতে চাইতো। অবশ্য এটা সে সত্যিই চাইতো। পড়ার প্রতি খুব আন্তরিক ছিলো মেয়েটি। সবাইইকেই পড়তে বলতো। নিজেও পড়তো। আর পড়া বোঝাতে হলে আমার নিজের আগে বুঝতে হতো।
বারো থেকে সাত, সাত থেকে চার, চারথেকে তিন। অর্থাৎ খুসুসী জামাতের বার্ষিক পরীক্ষায় আমার মেধাস্থান বারো ছিলো, মিজানের বার্ষিকে আমি তৃতীয় হলাম।
ইয়াসমীন দশের ভেতরেই থাকতে লাগলো। সেও কম কিছু নয়।
আমার হাতের লেখা খারাপ ছিলো, ইয়াসমীনের হাতের লেখা পড়ার অযোগ্য ছিলো। আমি ওকে লেখা শেখাতাম।
শেখাতে শেখাতে আমার হাতের লেখা সুন্দর হয়ে গেলো – ওর হাতের লেখা মুক্তোর মত হয়ে গেলো।
প্রতিবার বন্ধের আগে ইয়াসমীন একগাদা বই এনে দিতো আমাকে। পুরান দুষ্প্রাপ্য সব বই – ও জোগাড় করে দিতো। অবশ্য গুনে গুনে হিসেব করে আবার ফেরত নিয়ে নিতো ঠিক ঠিক। একটা বই রেখে দেয়ার কোনো সুযোগ ছিলো না।
ইয়াসমীনের আম্মু একদিন এসেছিলেন আমাদের বাসায়। কয়েকপদের পিঠে হালুয়া বানিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। আমাদের দাওয়াত দিয়েছিলেন সবাইকে তার বাসায় যাবার। সপরিবারে দাওয়াত কবুল না করলেও আমি একদিন গিয়েছিলাম ওদের বাড়িতে।
মাদরাসায় মূলত আমি আবাসিক থাকলেও অনাবাসিকের মতই থাকতাম। আমার দুটো আইডি কার্ড ছিলো – একটা আবাসিকের, অন্যটা অনাবাসিকের। দ্বিতীয় কার্ডটা আমাকে যখন তখন বাসায় যাবার অনুমতি দিতো। বিশেষ করে বুধবার – সাপ্তাহিক বিচারের মজলিশ হতো সেদিন বিকেলে – আমি সেইদিন পুরোদস্তুর অনাবাসিক হয়ে বাসায়। নাহয় সারা সপ্তাহের আমলনামার হাশর দিবসে আমার কপালে নির্ঘাত দুর্ভোগ আনতো। ফজরের পরের ঘুমের হাত থেকে আমি কোনোদিনও নিজেকে মুক্ত করতে পারিনি। প্রতিদিন ঘুমানোর শাস্তি পাঁচবার কানধরে উঠবস করা। পাঁচছক তিরিশবার কানধরার হাত থেকে বাঁচতে অনাবাসিক হওয়া ছাড়া গতি কী ছিলো আর। সেই সাথে অন্যান্য কানুন ভঙ্গের টুকটাক শাস্তিও থাকতো। তেমনি এক বুধবার দুপুর একটা দশে ক্লাস শেষ হতে আমি বাসায় যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু আম্মু নানাবাড়ি গেছেন, খালামণিও। আব্বু বাসায় আছেন কিনা জানা নেই।
আবার সবমিলিয়ে পঞ্চাশবারের মত কানধরার মামলা বিকেলে। সোমবার রাতে ভাত খেতে ভুলে গিয়েছিলাম, সকালে ফেলে দিয়েছি, সে বাবদ ঘুমের সাথে আরো বিশবারের কানধরা যোগ হয়েছে। এতবড় ঝুঁকি নিতে মন চাইছিলো না। বোরকাটা পরে চুপিসারে বের হয়ে গেলাম। সিঁড়ি টপকে দারোয়ানকে কার্ড দেখিয়ে বের হতে দেখি ইয়াসমীন যাচ্ছে ওর বাবার পেছন পেছন।
আমাকে দেখে কাছে এসে জানতে চাইলো
– খালাম্মা বাসায় নেই, তুমি কোথায় যাচ্ছো?
– বাসায়, আব্বু আসবেন আসরের সময়।
– ততক্ষণ কী করবে?
– গোরস্থানে গিয়ে বসে থাকবো।
আমার আব্বু গোরস্থান মসজিদের ইমাম। বাসার ছয়ফুট দূরে বিশাল গোরস্থান। ফুলে ও সবুজে ছেয়ে থাকে বারোমাস। সেখানে দিব্যি দুচারঘণ্টা বসে থাকা যায়।
ইয়াসমীন একটু ইতস্তত করে জানতে চাইলো – আমার সাথে যাবে? আমাদের বাড়ি?
আবার দিয়ে যাবো।
আমি থমকে গেলাম। একটু চমকেও।
আমার দ্বীধা ওর চোখ এড়ালো না।
– ভয় পাচ্ছো তুমি?
একটু যেন বেদনা ঝরে পড়লো ওর কণ্ঠে।
আমি রাজি হয়ে গেলাম।
ও দুপা এগিয়ে ওর বাবাকে কিছু একটা বললো, তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন। আমাকে দেখলেন ও হাসলেন।
এগিয়ে গিয়ে কালো জীপ গাড়িটির দরোজা খুলে দিলেন।
ইয়াসমীন ভেতরে ঢুকে আমাকে ইশারা করলো। ভয়, শংকা পাশে রেখে কৌতূহলী মন নিয়ে আমি ও পাশে বসলাম। চাচাজি ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি ছেড়ে দিলেন।
এমন না যে আমি কখনও কারও বাসায় যাইনি। বরং বরিশালে যাদের বাসা, সেসব সহপাঠীদের বাড়িতে গিয়েছি। তবে বাসায় বলে। আর ইয়াসমীনের ব্যাপারটা ভিন্ন। ও আমার সবচে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তার ওপর অনাবাসিক – ওর বাসায় যাওয়াই স্বাভাবিক।
কিন্তু ওর মা একদিন বলা ছাড়া ও নিজে থেকে আজকের আগে কখনও বলেনি যাবার কথা। আমিও একদিন মজা করে বলা ছাড়া বলিনি। ক্লাসের আর সবার সাথে ওর খুব ঘনিষ্ঠতা ছিলো না, আবার শত্রুতাও না। ওর অভিজাত ও পরিপাটি চাল – চলন সেই সাথে স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য ওকে সবার থেকে দূরে সরিয়ে রাখতো। মূলত আমাদের ক্লাসের ও মাদরাসার বেশিরভাগ ছাত্রীই ছিলো গ্রামের। ওকে তারা খুব আপন ভাবতে পারতো না। আর আমরা যারা শহুরে ছিলাম তারাও শহুরেপানা ছেড়ে ওদের সাথে মিশে যেতাম নির্দ্বিধায়, আর ওরাও আমাদের সাথে থেকে থেকে চলনসই শহুরে হয়ে যেত। কিন্তু ইয়াসমীন ছিলো সবারচে আলাদা। ও কখনই সবার হতে পারেনি। তাই আমার সাথে অন্য সবার সাথে আন্তরিক সম্পর্ক থাকলেও ওর সাথে আমি ছাড়া কারও সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।
অথচ আমি যে খুব ওর মত – তা নয়। বরং ঠিক উল্টো। মাদরাসায় যতক্ষণ থাকতাম আঞ্চলিক ভাষাতেই কথা বলতাম। কাপড় কখনও রঙ ম্যাচ করে পরা হতো না, যখন যা সামনে পেতাম তাই। পুরোপুরি উলুল ঝুলুল একজন মানুষ। বই খাতা কলমেরও ঠিক ছিলো না। অবশ্য এই কটা জিনিস ইয়াসমীন খুঁজে দিতো ও গুছিয়ে রাখার চেষ্টা করতো। মাঝে মাঝে বলতাম – তুমি অাবাসিক থাকলে বেশ হতো, আমার কাপড় চোপড় বিছানা ঠিক থাকতো।
আমি ও ছাড়া আমার ক্লাসমেট কাউকে তুমি করে বলতাম না। আমি তো আমার বড় ক্লাসের আপুদেরও তুই করে কথা বলতাম, ছোটদেরও। অবশ্য তারাও আমাকে তাইই বলতো।
যাকগে, কোথা থেকে কোথায় এলাম। আমি এখন গাড়িতে চড়ে যাচ্ছি ইয়াসমীনদের বাড়ি। গাড়ির গতি ষাটের ওপরে। শহর ছাড়িয়ে গেলাম মুহুর্তে।
জানতে চাইলাম – কতক্ষণ লাগবে?
ইয়াসমীন বললো – ভয় পেয়োনা। বিশ পঁচিশ মিনিট।
আমি রেগে গেলাম – আরে তুমি বারবার ভয় না পাবার গান গাইছো কেন? ভয় পেলে আসতাম? ভয় পাবার কী আছে? কখনও এমন হয়েছে? না কাউকে কিছু বলেছি?
ইয়াসমীন চমকালো ও থমকালো।
তারপর আস্তে করে আমার হাত ধরে বসে রইলো।
আর আমিও বেমক্কা কথা বলে বেকুব হয়ে বসে রইলাম।

ক্লান্তি আর খিদে নিয়ে কখন যে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে গেছি টের পাইনি।
গাড়ির ঝাঁকুনিতে জেগে উঠলাম।
পাহাড়ী রাস্তায় তুরন্ত গতিতে জীপ চলছে।
পাহাড়ী গ্রামের মাঝ দিয়ে ছুটছে গাড়ী।
ঠোঁট কামড়ে চুপ করে রইলাম। ইয়াসমীন ভয়ে ভয়ে আমার দিকে চাইলো। আমার নির্বিকার মুখ দেখে চুপ গেলো।
আড়মোড়া দিয়ে বললাম – আর কতক্ষণ?
বাইরে সবুজ গ্রাম। পাথরের বাড়ী। পথের দুপাশে উজ্জল সব ফুল। মাঝে মাঝে ফলের গাছ, ফলের ভারে নুয়ে পড়ছে যেন। অধিকাংশই আমার অচেনা।
– এসে গেছি তো।
গাড়ি বাঁক নিয়ে একটি ছোট রাস্তায় ঢুকে গেলো। রাস্তার শেষ মাথায় একটি বাড়ি দেখা যাচ্ছে।
বলতে বলতেই গাড়ি থেমে গেলো।
প্রথমে ও নামলো, তারপর আমাকে হাত ধরে নামালো। ছোট্ট একটা পাথুরে উঠোনে থেমেছে গাড়ী। ঠিক পাথরও নয়, লালচে শক্ত মাটির ওপর প্রথম পা’টা রাখলাম বিসমিল্লাহ বলে। মনের সমস্ত জোর একত্রিত করে বের হয়ে এলাম। উঠোনে খেলতে থাকা চার – পাঁচটি শিশু আমাকে দেখে উঠে এলো। মুহুর্ত পরেই এলেন ইয়াসমীনের মা।
এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। দুপা এগিয়ে আমি ধপ করে বসে পড়লাম বড় একটা গাছের ছায়ায় বিছানো পাটির ওপর। ততক্ষণে চাচাজি চলে গেছেন। হাত পা মোজা খুলতে খুলতে শুকনো গলায় পানি খেতে চাইলাম। একটা বাচ্চা মেয়ে দৌঁড়ে চলে গেলো এক কোনায় বাঁধানো কুয়োর পাড়ে। ঝটপট ছোট একটা বালতিতে করে পানি তুলে নিয়ে আসলো। পেতলের ঝকমকে বালতিই আমাকে দিলো পানি খেতে। কিছুটা অপ্রস্তুত ইয়াসমীন ওকে গ্লাস আনতে বললো। ততক্ষণে আমি বালতিতেই চুমুক দিয়ে পানি পান করে নিলাম। তারপর উঠে কুয়োর পাড়ে গিয়ে নিজেই পানি তুললাম।মাথায় পানি ঢাললাম। অযু করলাম। পাটিতে ফিরে এসে জোহরের নামাজ পড়লাম।
নামাজ পড়ে অনেকটা প্রফুল্ল লাগলো। ঘুরে বসতেই দেখি প্রমাণ সাইজের দুটো থালায় ফল ও মিষ্টি হাজির। আমার মত দশজনের খাবার খেতে দিয়ে খালাম্মা যখন বললেন,” নাস্তা খেয়ে নাও – ইয়াসমীন কিছু না জানিয়ে তোমাকে নিয়ে এসেছে। তোমার খাবার তৈরি হচ্ছে ” তখন আমি আক্ষরিক অর্থেই ভড়কে গেলাম।
– জ্বী অাচ্ছা, খালাম্মা। বলে বিষদৃষ্টিতে ইয়াসমীনের দিকে চাইলাম। ও আঁচলের নিচে চাপা হাসি দিলো।
খালাম্মা চলে গেলেন। ইয়াসমীন গোসল করে ফেলেছে এরই ভেতর। লম্বা কোর্তা ও বিশাল ওড়নায় ইয়াসমীনের সীরাত সুরত পাল্টে গেছে।
আমি কয়েকটা আঙ্গুর ও দুটো সন্দেশ মুখে দিয়ে উঠে পড়লাম, এতেই পেট ভরে গেলো। মাঝারি সাইজের উঠোন। উঠোনের একপাশ ঘরের দিকে একটা নাম না জানা বিশাল গাছ। অনেকটা রেইনট্রির মত, যেটার নিচে বসে ছিলাম। আরেকপাশে আঙ্গুর ঝোপ। ঘর থেকে বেরিয়েই পাথরের বাঁধানো কুয়ো। নানান আকারের পেতলের ঝকমকে বালতি ঝুলছে কুয়োর পাশের আড়ায়।পাথর আর ইটের তৈরি বাড়ি। বেশ বড়সড়। ওপরের দিকটাতে শুধু ফুল আর ফুল। একটা মমাঝারি আকারের টিলার পাথুরে টিলার ঠিক মাঝখানে বাড়িটা। পাথুরে মাটি কেটে কেটে রাস্তা বানানো । চারদিকে ছোট ছোট অনেক পাহাড়। পাহাড় না বলে পাহাড়ী টিলা বললে ভালো হয়। প্রতিটি টিলায় বাড়ি। কোনো কোনো টিলায় একাধিক বাড়িও আছে। সবুজে ছেয়ে আছে টিলাগুলো, ফল আর ফলের গাছ, চেনা।আর টিলার ঢালগুলো যেন সবুজের কার্পেট। ঘাস আর ঘাসফুল যে এত সুন্দর হতে পারে আগে কোনোদিন জানা ছিলো না। একটু দূরে বেশ খানিকটা সমতল জায়গা। একেটা পাহাড় যেন একেকটা গ্রাম। জনপদ ছাড়িয়ে বিশাল শষ্যক্ষেত। যব আর ভুট্টোর শীষ দুলছে বাতাসে। শরতের উজ্জল রোদে ঝলমল করছে করছে পৃথিবী। পেঁচানো রাস্তা পেরিয়ে একটু নিচে বড় রাস্তা। দুইধারে সব অচেনা গাছ।
আর সবচে সুন্দর বাড়ির পেছন দিকটা।
একটু উঁচু এই দিকটা। দক্ষিণে পাহাড় খাড়া হয়ে গেছে, আর সে পাহাড়ের বুক চিরে নেমে এসেছে ছোট্ট এক ঝরণা।
ইয়াসমীনের ছোটবোন চোস্ত উর্দুতে বুঝিয়ে বললো,- এই ঝর্ণার পানিই মাটির নিচ থেকে গিয়ে কুয়োয় জমা হয়। ঝর্ণার চারদিক জুড়ে পরিকল্পিত বাগান। একপাশে ফুল আর ফুল। আরেকপাশে ফল। নালা কেটে বইয়ে দেয়া হয়েছে বাগানের ভেতর দিয়ে। আমি নালা টপকে টপকে ফুলের বাগানে গিয়ে বসলাম।
বাগানে গোলাপের আধিক্য বেশি। আর বেশিরভাগ ফুলই আমার অচেনা। জুঁই দেখলাম। হেসে বললাম – ইয়াসমীন!
ইয়াসমীনের ছোটবোন আফরিন। ওর সাথে বেশ খাতির হয়ে গেলো। ওর অভয় পেয়ে পাথরে বসে ঝর্ণায় পা ডুবিয়ে দিলাম। স্বচ্ছ পানিতে রঙিন মাছের ঝাঁক। মাছগুলি কিনে এনে ছাড়া হয়েছে এখানে। আফরিন বললো, ইয়াসমীন শুধু ভাবে, বিয়ের পর এই ঝর্ণা আর বাগান ছেড়ে কিভাবে থাকবে?
ইয়াসমীনের হবুবর এটা জানতে পেরে ঝর্ণার ধারে নিজের বাগানবাড়ি বানাচ্ছে এটার মত করে!
আমি ঢোক গিললাম।
– ইয়াসমীনের হবুবর?
-হুঁ, আপার তো সেই কবেই বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, সর্দারজীর ছেলের সাথে। পড়া শেষ হলেই বিয়ে।
– তুমি পড়ো না?
– নাহ! পড়তে অনেক কষ্ট, আপা যেই হাঙ্গামা করে পড়েন – আমি পারবো না। আমি আপার কাছে পড়ি।
আপার পড়া শেষ হলে আপা একটা মাদরাসা করবেন।
সেটাতে সবাই পড়বে। আমিও।
-আচ্ছা।
মনের সুখে পা দোলাতে দোলাতে আমি বেখেয়ালে ঝপ করে পড়ে গেলাম ঝর্ণার পুকুরে! আফরিনও লাফ দিলো। টেনে নিয়ে অপেক্ষাকৃত কম।গভীর জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিলো। অবশ্য সব জায়গায়ই পানি কম। এটা একটা ছোট ঝর্ণা। বেশ হলো।
পাথর তুললাম ডুব দিয়ে। রঙিন নুড়ি পাথর। মাছগুলোকে ভয় দেখালাম। ডুবসাঁতার খেললাম।
ভাগ্যিস বাসায় যাবার জন্য ব্যাগে একসেট কাপড় নিয়েছিলাম। ইয়াসমীন দেরি দেখে খুঁজতে এসে অবাক হলো। আমাদের কান্ড দেখে চোখ রাঙানি দিলো। আফরিন ওর চোখে পানি ছিটিয়ে দিলো। রেগেমেগে পাড়ে আসতেই দুজনে মিলে ওকেও টেনে নামালাম। আরো কতক্ষণ ঝর্ণার সাথে মাতামাতি করে উঠে গেলাম। একটু দূরে পাহাড়ী নদী। মাঝে মাঝেই বাতাসে ভেসে আসে স্রোতের আওয়াজ।
সবমিলিয়ে এত সুন্দর কাটলো সময়, আমার ঘড়ির কাঁটার কথা মনে ছিলো না।
কিন্তু হেলে পড়া সূর্য দেখে আঁতকে উঠে ঘরের দিকে হাঁটা দিলাম। আসরের পর বাসায় যেতে হবে ।
উঠোনে পা দিয়েই খাবারের সুঘ্রাণে পেটে মোচড় দিয়ে উঠলো। কয়েকটা আঙ্গুর আর দুটো সন্দেশ হজম হয়ে গেছে সেই কখন। আমার মনে হচ্ছিলো আমি এখন আস্তো একটি মুরগী খেয়ে ফেলতে পারবো।

কয়েকপা সামনে এসে ভড়কে গেলাম।

বিশাল রুপোর প্লেটে চিৎপাত হয়ে আছে আস্তো এক ছাগল। আরেক কোনায় কয়লার আগুণে কাবাব হচ্ছে কিছু একটা। ফিসফিসিয়ে আফরীনকে জানতে চাইলাম – ও কি?

গরুর ঠ্যাঙ ” বলে মিচকা হাসি দিলো সে।
এবার আর বাইরে নয়, ঘরের ভেতর গিয়ে বসলাম। পাথরের ঘর, শীতল আরামদায়ক।

ঘরের ভেতর খুব আলো নেই, আবছায়া। অনেকটা অন্ধকারাচ্ছন্ন চাইনিজ রেস্তোরার মত পরিবেশ।

হাতড়ে হাতড়ে গেলাম খাবার ঘরে।

এই ঘরটা খোলামেলা, আলো বাতাসের প্রাচুর্য। জানালার ওপাশেই ফুটে আছে রঙ্গিন ফুল। মেঝেতে ফরাশ বিছানো, কার্পেটে টাখনু ডুবে যায়। মাঝবরাবর বিঘৎখানকে উঁচু পাথরের টেবিল।

আস্তো ছাগল আর গরুর বিশাল কাবাব চলে এসেছে ইতোমধ্যে। এরপর আসলো পোলাও, আর পরোটা। পরোটার আকার দেখে আমি অসহায় দৃষ্টিতে তাকালাম ইয়াসমীনের দিকে। সে মুচকি হাসলো।

খালাম্মা চলে এলেন এর ভেতর।

আমি প্রস্তরবৎ বসে আছি।

নাম না জানা বিশালাকার এক মাছ ভাজা।

জাম্বুরার সমান মিষ্টি।

আমি শোকে পাথর হয়ে বললাম – তোমাদের বিয়েতে আমাকে ডাকবে না। আমি মারা যাবো তবে।

দুবোন হেসে লুটোপুটি খাচ্ছিলো।

ইয়াসমিনের ছয় ভাই।

ছোটদুইজনকে দেখলাম।

দূর থেকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে পালায়।

বাকীরা মাদরাসায়।
বিশাল রুপোর প্লেট আমার সামনে দিয়ে খালাম্মা বিসমিল্লাহ বলে পোলাওয়ের গামলায় চামচ দিলেন। আস্তো মুরগির কথা ভাবছিলাম একটু আগে, সেটা মোরগ হয়ে এসে প্লেটে চড়লো।

আমি পোলাও খাইনা, খাইনা মাছ গোশত।
সব্জি আর ডিম আমার খাওয়া।
সেটা মুখ থেকে বের করার কোনো পরিস্থিতি নেই।
মোরগ খেলাম, গরু খেলাম।
পোলাওয়ের ভেতর কবুতর, ঘুঘু, আর কিসের যেন রোস্ট ছিলো – তা খেলাম না।
মাছ খেলাম।
এমনকি জীবনে না খাওয়া ছাগলও খেলাম।
একটা ব্যাপার ছিলো, অসাধারণ রান্না।
যে কেউ খেতে বাধ্য হবে।
খাওয়া শেষে মিষ্টি খেলাম আধখানা।
তারপর সেখানেই শুয়ে পড়লাম।
ক্লান্তিতে তৃপ্তিতে ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিলো প্রায়, এমন সময় আজান দিলো।
আসরের আজান, আমার ঘুম টুটে গেলো।
বাসায় যেতে হবে, উঠলাম।
উঠোনের কূপের ঠান্ডা পানি দিয়ে অযু করে নামাজ পড়লাম।

তখন সূর্যের পড়ন্ত সময়। রোদের ঝাঁঝ কোমল হয়ে গেছে। সোনালী রঙ যেন গলে গলে পড়ছে পাহাড়ের চূড়োয়। আবার সেখান থেকে গড়িয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের সবুজে। সবুজে সোনালীতে মিলে স্বর্গীয় আভায় ভরে উঠেছে আমার চারিপাশ।

আমার বাসায় যাবার কথা মনে থাকলো না। মাথার নিচে হাত দিয়ে আমি জায়নামাজে শুয়ে পড়লাম। ওই দূরে ওটা কি ঝাউগাছ?

আর পথের পাশে বড় বড় ওগুলো, মুজতবা আলীর সেই চিনার বৃক্ষ ? বাতাসে গাছের শাখায় শনশন রব উঠেছে, আমি তন্ময় হয়ে দেখি। ঠিক এভাবেই হয়ত সারাজীবন কাটিয়ে দেয়া যায়।

আমার ভাববিলাসে ছেদ পড়লো টুংটাং আওয়াজে।

সেদিকে  না দেখেই বুঝতে পারলাম চা বানাচ্ছে ইয়াসমীন।

ওঠো, বাসায় যেতে হবে না?
নাহ, এখানেই থাকবো সারাজীবন।

হেসে ফেললো ও, – আস্তে বলো, আম্মা শুনলে রেখে দিবেন কিন্তু। তার দুইটি প্রায় বিবাহযোগ্য ছেলে আছে!

আমার সেরকম কোনো আপত্তি নেই তাতে। বলে হেসে ফেললাম আমিও।
ইয়াসমীনের বেদনা আমার চোখ এড়ালো না।

আমি জেনে বুঝেই বলেছি, সে কি তা বুঝেছে? নাকি না বোঝার ভান ধরে আছে।

সেই মুহুর্তে আমার ইচ্ছে করছিলো – ও সবকিছু বলে দিক।

উঠলাম। চা খেলাম।

পিঠা খাবার জায়গা পেটে ছিলো না।

অনিচ্ছা নিয়েই বাসায় যাবার জন্য বোরকা পড়লাম। ওর মায়ের সাথে কথা বললাম। তিনি পরেরবার আসার সময় জানিয়ে আসতে বললেন, তেমন কিছুই খাওয়াতে পারেন নি বলে আফসোস করলেন খুব।

আমি আফরিনের কাছে জানতে চাইলাম, বলে আসলে পোলাওয়ে ভেতর ঠিক কয়পদের পাখির রোস্ট থাকবে আর ছাগলের বদলে আস্তো উট থাকবে কিনা?
বেচারি সিরিয়াসভাবে নিলো কথাটা।

উট থাকার কথা দিলো, আর ভাইদের বন্ধে আসলে পঞ্চাশরকম রোস্টের ওয়াদা দিলো।

নগদ দিলো ফুল আর পাথর।

সবাইকে বিদায় জানিয়ে কালো গাড়িতে চড়লাম। সাথে ইয়াসমীন, ও আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। গোঁফে তা দিতে দিতে ড্রাইভিং সিটে বসলেন ওর বাবা। সেই স্বর্গীয় আভায় সবুজের ভেতর দিয়ে পথ চলতে লাগলো গাড়ি। ইয়াসমীন আমার হাতে একটি আঙটি পড়িয়ে দিলো, নাগিনা ছাড়া রুপোর আঙটি।

বললো, তোমাকে দেবার জন্য কিছুই যথেষ্ট নয়, কিন্তু দামী কিছু তোমাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করবে আর তুমি হারিয়ে ফেলবে।

তাই এটাই রাখো।

আজও আমি রুপোর আঙটি পরি, সব ধরণের গয়নার প্রতি বিমুখ হলেও।
গাড়ির নরম গদি ক্লান্ত আমাকে কখন ঘুমের দেশে নিয়ে গেলো জানি না। যখন ইয়াসমীন আমাকে জাগালো – তখন আমি বাসার গেটে, মাগরিব হয় হয় সময়। আব্বু বের হয়েছেন – ইয়াসমীনের বাবাও নেমে এসেছেন গাড়ি থেকে।

দুজনে দুজনের দিকে দীর্ঘসময় অনড় দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। আজান দিতে দুজনের চোখ নামলো। সালাম দিলেন প্রথমে ইয়াসমীনের বাবা, আব্বু তখনও স্থির। তারপর জবাব দিয়ে মসজিদের দিকে চলে গেলেন। অামরা একটু অবাক হলাম।

ইয়াসমীনের বাবা মৃদুকন্ঠে বললেন – আহমাদ আমার সহপাঠী ছিলো।

রাত ঘন হচ্ছে, চাঁদ যেন আরও তরল হয়ে গলে গলে পড়ছে, কীর্তনখোলার ঢেউ বাতাসে বাতাসে আছড়ে পড়ছে সশব্দে।

নদীর এই ঢেউয়ের আওয়াজে অপূর্ব একটা ছন্দ আছে। দীর্ঘক্ষণ কান পেতে থাকলে টের পাওয়া যায়। আমার মনযোগ বারবার ছুটে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে নিশাচর পাখির ডাক। প্রথম ফাল্গুনে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে বাতাস। একটু কি পাতলা চাদর ছড়িয়ে দিয়েছে কুয়াশা? আমার ওঠা দরকার। রুমে গিয়ে লেপ মুড়ি দেয়া দরকার।

আমার উঠতে ইচ্ছে করছে না।

যখন ডুবে যাবে চাঁদ, পূবাকাশে জ্বলজ্বল করবে শুকতারা তখনও আমি এভাবে বসে থাকবো ঠায়। আমার সামনে পড়ে আছে নীল খাম।

ইয়াসমীনের কথা বলতে গেলে রাত ফুরিয়ে যাবে, কথা ফুরোবে না। দিন পার হয়ে যাবে – গল্প শেষ হবে না।

একবার অামি যখন সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাদের মাদরসার ছাদে রাতে গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ আর লাফালাফির একটা হেস্তনেস্ত আমি এইবার করেই ফেলবো – সে সিদ্ধান্ত নিলো আমার সাথে সেও থাকবে।

বললাম, তুমি অনাবাসিক।
বললো – আবাসিক হয়ে যাবো।
সত্যিই তিনদিনের জন্য থাকতে এলো সে কাপড় চোপড় নিয়ে।

রাতে সবাই ঘুমিয়ে যাবার পর আমরা উঠলাম। ওর বাসা থেকে দিয়ে যাওয়া খাবার ভাগ করে খেলাম। খেতে খেতে ও বললো – বাসার কেউই ওকে আসতে দিতে রাজি হয় নি। ও জোর করে এসেছে, “ভাইয়ারা তো থাকে, তাদের কিচ্ছু হয় না – আমার হবে কেনো? ”
আমি চমকে এবং থমকে গেলাম।

পূর্ণদৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে অতিরিক্ত মনযোগ দিয়ে খাওয়া শুরু করলাম।

খেয়ে দেয়ে গেলাম ছাদে।

আগে থেকেই ছাদের চাবি সরিয়ে রেখেছিলাম আপার বালিশের নিচ থেকে।

সেদিন রাতে কেউই ছাদে আসলো না, ইট ভাঙ্গলো না। আমাদের কেটে রাখা “কোটে ” শিলপাটার পুতো ভেঙ্গে কুতকুত খেললো না।

ছাদে দুটো বেঞ্চের ওপর শুয়ে ফজর তক অপেক্ষা করে চলে এলাম।

আমি যে ভয়ে থরথর করে কাঁপছিলাম সেটা ইয়াসমীন জানে না।

পরে আমি বুঝতে পেরেছিলাম – কেনো সে তিনদিনের জন্য এসেছিলো ঝুঁকি নিয়েই।

খোদা স্নেহ, সম্মান আর বন্ধুত্ব – ভালোবাসার তিনটি দরোজাই আমার জন্য অবারিত করে রেখেছেন চিরকাল।

আমি ইয়াসমীনের বন্ধুত্ব ও বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছিলাম এ ভাবলে আজও গর্বে আমার হৃদয় ভরে ওঠে।

পরেরদিন সিদ্ধান্ত নিলাম যখন শব্দ হবে ঠিক তখনই যাবো ছাদে।

বুকের ভেতরের কাঁপন ও ভয় চাপা দিয়ে বসে রইলাম – খোদা এ কোন মহাপরীক্ষায় ফেললেন আমাকে জানি না।

সেদিন ছাদে কোনো শব্দ হলো না।

তিনদিনের দিন, আমি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে রইলাম, সেদিন ঠিক শুরু হলো ছাদে ধমাধম।

উঠে দেখি পাশে ইয়াসমীন নেই, বালিশের নিচে চাবি নেই।

দৌঁড়ে গেলাম সিঁড়িতে। ছাদের দরোজার সামনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইয়াসমীন। সে আমাকে যেতে দিলো না।

“ধরো – খুব ভয়ঙ্কর কিছু আছে – তোমাকে ভয় দেখাবে, তুমি তখন কী করবে? ”

আমি ভয় পাই না।
ভয়ের জিনিস তো ভয় পাওয়াই উচিত – তাই না?

উচিত! তাই?

আমি স্থির দৃষ্টিতে তাকালাম ওর চোখে।

অস্বস্তিভরে চোখ সরিয়ে নিলো সে।

আমি হেসে ফেললাম।

আচ্ছা, যাচ্ছি না – তবে আওয়াজও তো থেমে গেছে।
রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম ফের।
আর কখনও আমার জীন ভূত দেখার কৌতূহল হয় নি।

নাহবেমীর পড়া শেষে আমার বিয়ে হয়ে গেলো। একই সাথে থেকেও আমি যেন সবার চেয়ে আলাদা হয়ে গেলাম। সুক্ষ্ম একটা বিভেদরেখা আমাকে আর সবার থেকে আলাদা করে দিলো।

ইয়াসমীনের সাথেও সম্পর্কটা খাপছাড়া হয়ে গেলো কতকটা।

একদিন আনমনা হয়ে ছিলাম, মন খারাপ ছিলো – মেজাজও।

হেদায়াতুন্নাহু নোট করা নিয়ে কথায় কথায় তর্ক লেগে গেলো দু’জনার।

ব্যস কথা বন্ধ।

দুইবছরে কখনও যার সাথে কথা বন্ধ হয়নি, সামান্য বিষয়ে দুজনেই কেন যে সেদিন রুঢ় আচরণ করেছিলাম – কে জানে!

অথচ আমি বা ইয়াসমীনের সাথে কখনও কারও সাথে তেমন একটা তর্ক হতো না।

সেখানে আমাদের ভেতরই ঝগড়া লাগায় সবাইই একটু অবাক হলো।

আমি নিজেও।

দিন যায়, সপ্তাহ – মাস।

অভিমানের পাহাড় জমে, তার নিচে আছড়ে পড়ে ঢেউ। ভেতরে কষ্ট, ওপরে নির্বিকার।

আমার নতুন জীবন, শ্বশুরবাড়ি থেকে পড়াশোনার বিরোধিতা, বিয়ের পরেই রাজনৈতিক মামলায় “তার “কারাগারে যাওয়া, মুক্তি – সবমিলিয়ে বিধ্বস্ত অবস্থা আমার। কারও কাছে বলার নেই কিছু।

আমি পড়বোই – সিদ্ধান্তে অটল থেকে জগৎ সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিলাম নিজেকে।

সেই দুঃসহ সময়ে আমি চাইতাম – ইয়াসমীন আমাকে ডাকুক। জিগেশ করুক – আমি কেমন আছি।

কিন্তু পাশাপাশি থেকেও কী নির্বিকারই না ছিলো সে!

পরীক্ষার রেজাল্ট দিলো  পরীক্ষার। তিন বিষয়ে লেটার মার্ক পেলাম, তিন বিষয়ে ফেল করলাম। আরেক বিষয়ে টেনেটুনে পাশ করলাম। প্রথম স্থান থেকে বারো নম্বর স্থানে চলে গেলাম। ইয়াসমীন তৃতীয় হলো।

রেজাল্ট ঘোষণার সময়ে মুচকি হেসে তাকে অভিনন্দন জানালাম।

কিন্তু তার দৃষ্টিতে ফেরত পেলাম বিষন্নতা।

বছর পেরিয়ে যায়।

আমি আরও নিঃসঙ্গ হই।

একদিন – সেদিন বসন্ত ছিলো, তবু আকাশে মেঘ জমেছিলো। ঠান্ডা এলোমেলো বাতাস।সারাদিন।

সারাটা দিন ছাদে রইলাম।

রাতেও।

সেদিন ইয়াসমীন বাসায় গেলো অথবা গেলো না।

রাতে ফাল্গুনে হুট করে নেমে আসা বৃষ্টিতে আমি যখন ভিজছিলাম, তখন রাত বারোটা বাজে।

আমার পারিপার্শ্বিক সমস্যা ও অবস্থা আপারা কিছুটা জানতেন বলে – আমাকে তারা একরকম অলিখিত স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছিলেন। শাসন ও নিয়মের বাইরে নিজের মত করে থাকতে দিতেন।

আর সহপাঠীদের থেকে তখন আমি অনেক দূরের মানুষ।

এমন হাজারো ভাবনায় ডুবে আছি – এমন সময় ইয়াসমীনের ডাক শুনতে পেলাম পেছন থেকে – মারজান!

আমি ঘাড় গুঁজে বসে রইলাম।

বৃষ্টির জলে মিশে যাওয়া চোখের জলের সাক্ষী কেউ না হোক।

আমার পাশে বসে ভিজতে লাগলো সেও।

একসময় বললো – আজ তোমার জন্মদিন।

সবকিছু ভুলে যাও। নতুন করে শুরু করো – সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

আমার তখন মনে পড়লো, আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। সেটা ছিলো আমার ষোলোতম জন্মবার্ষিকী। সেই থেকে প্রতি জন্মদিনে তার শুভেচ্ছা জানানো শুরু।

আমি জানতাম – সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

সবকিছু ঠিক হবার পথে।

কতদিনের যুদ্ধ আমার, পরিবার আর পারিবারিক প্রথা, শ্বশুরবাড়ি সবার বিরুদ্ধে ঘোষিত যুদ্ধে আমি জিতে যাচ্ছি তখন। পুরো নয়মাসে নিঃসঙ্গ যোদ্ধা আমি তখন ক্লান্ত।
আমার হাসি পেলো, “তুমি না বললেও সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে এখন, এখন আমার আর শান্তনার দরকার নেই ”
ইয়াসমীন লজ্জিত হলো।

“আমি সব জানতাম, কিন্তু আমি বুঝিনা তো কিচ্ছু, কী বলবো তোমাকে বুঝতে পারি নি  ”
আমার হাসি আসলো, বেচারী! মনুষ্যজগতের জটিল টানাপোড়ন ওর তো বোঝার কথাও নাহ।

ষোলোটি গোলাপের তোড়া মন বিশেষ ভালো করে দিলো।

পরে একদিন আমি জানতে চেয়েছিলাম, তুমি কোন সাহসে আমার সাথে ঝগড়া করলে? ডরভয় বলে কিছু নেই তোমার?
“তোমাকে বিশ্বাস করি। আব্বু বলেছেন – আহমাদ বিশ্বাস ভাঙ্গে নি – তুমিও কোনোদিনও ভাঙ্গবে না ”
“ও! আব্বুও তাহলে জানেন সব! ”

“কিছুটা ”
আমি কোনোদিনও কাউকে বলি নি তোমার কথা – ইয়াসমীন!

ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম আমি।

তারপর হাত বাড়িয়ে সযতনে খুলতে লাগলাম নীলখাম।

ভাবনার অতলান্তিক সমুদ্দুর আমার হৃদয়ে, কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে।
★ইয়াসমীনের চিঠি।
আফিফা!

ভালো আছো নিশ্চয়ই?

আমি জানি, তুমি ভালো আছো। খারাপ কখনো থাকো না তুমি। রহস্যময় এই জগতে যে বিপুল বিস্ময় ছড়িয়ে আছে তারমধ্যে এটাও একটা বিস্ময়কর ব্যাপার যে, মানুষ জাতি খুব ভালো থাকে না, অথচ তুমি সবসময় ভালো থাকো। মানবিক অনুভূতি থাকলে তোমার ভালো থাকার রহস্য উদ্ধার করার চেষ্টা হয়তো করতাম, কিন্তু সেটা সম্ভব নেই বলে ভেবে নিয়েছি – তুমি ভালো মানুষ বলেই ভালো থাকো।
আহা! রেগে যেও না আবার!

মনে করো কিছু বেহুদা বকওয়াস করলাম। মূলতঃ মানুষের ভেতর আমি তোমার মতো কেউ দেখিনি।

সবকিছু জেনেও বছরের পর বছর নির্বিকার থেকে যাওয়া; আমি মাঝে মাঝে অবাক হই। আফরিন বলে- ‘আফিফা মানবজাতির কলংক!’ ভালোবেসে বলে।
আহ! এই ভালোবাসা জিনিসটা বড় অদ্ভুত! পৃথিবী নামক গ্রহে এই একটা জিনিস সব ধরনের প্রাণীকে বেঁধে রেখেছে অদ্ভুত এক অদৃশ্য বন্ধনে। এই ভালোবাসাই অসহনীয় যন্ত্রণায় এখনো আমাকে উপশম দিচ্ছে।
তার আগে বলি- তুমি জানো না, দু’বছর ধরে একধরনের বন্দীত্বে বসবাস করছি আমি। অদ্ভুত এক রোগ হয়েছে আমার। হাকীম সাহেবেরা ধরতে পারছেন না। আমি রোগের নাম রেখেছি “কর্কট রোগ”।

মনুষ্যরোগের নাম। সারাক্ষণ দাওয়াখানা হয়ে আছে ঘরটা। কেউ পাতার রস বের করছে তো, কেউ লতার ধুয়ো দিচ্ছে। কেউ বড়ি বানাচ্ছে তো কেউ সিরাপ। কিন্তু আমি সমস্ত শব্দ ও যন্ত্রণার মাঝেও ভালোবাসার জোরে নীরবে হারিয়ে যেতে পারি ইচ্ছেমতো। কল্পনায় আবার শরীরী হই। সেই পুরনো দিনগুলি ফিরে আসে আমার কাছে, আমি নেড়েচেড়ে দেখি। সবার সাথে ক্লাস করি।  তোমার রাগ অভিমান দেখি। প্রথম আমাদের  দেখা হওয়া দিনটা তোমার মনে আছে? আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম – তোমাকে আছড়ে পড়তে দেখে, আর তোমার মারমুখো দৃষ্টি দেখে  তো হাওয়া হয়ে যাবার কথাও মনে এসেছিলো! কল্পনার সময়টা

বয়ে যায় তরতরিয়ে বুঝতেই পারি না। বাস্তবে ফিরে এলেই জাগতিক সব যন্ত্রনা ফিরে আসে। এমন কেন হয়!
কল্পনা জিনিসটা ভালো। বাস্তবে যা হয়না তাও হতে পারে। বাস্তবের চেয়েও ভালো। বাস্তব এত কঠিন কেন কে জানে!

হয়তো কোনো একদিন উদাসী দুপুরে  ঘুমন্ত তোমাদের শিয়রে বসে অগ্নিজগতের সমস্ত বিস্ময় নিয়ে আমি তোমার দিকে  তাকিয়ে থাকতাম এরকম ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানবজনমের পরম রহস্য ও গভীরতা ছুঁয়ে দেবার ইচ্ছায় – কিন্তু মানবের হৃদয়ের জটিলতা বোঝার ক্ষমতা আমাদের দেয়া হয় নি ।
আমাদের হায়াত দীর্ঘ হয়, কিন্তু তোমাদের সাথে বাস করে তোমাদের হায়াতের তাছীর পড়েছে হয়তো। খুব ইচ্ছে ছিলো

মেয়েটাকে তোমার মেয়ের সাথে পড়তে দেবো, বংশানুক্রম বজায় থাকুক। কিন্তু আমার অসুস্থতার কারণে কেউ রাজি হয় নি। এই চিঠি যদি তোমার কাছে পৌঁছে যায়, তবে আমার জন্য মাগফিরাত কামনা করো।
সেদিন মনটা এতো খারাপ হলো! আমাদের জান্নাত নিয়ে কত মতভেদ। যাই হোক, জাহান্নম নিয়ে মতভেদ নাই। সেখানে না গেলে মাটি হয়ে যেতে আপত্তি নেই আমার। মাটির প্রতি আমার যে ভালোবাসা; এইকালে মাটির ছিলাম না, ওইকালে মাটিই হলাম না হয়!

যদি জান্নাত লেখা থাকে তাকদীরে- ঠিক এমন একটি পাহাড় চাইবো আমি! এই আশ্চর্য সুন্দর জগতেই পুনরায় বাস করতে বড্ড ইচ্ছে করে।
তাসনীম আর আদনানের যখন মন খারাপ হবে, ওরা তোমার কাছে যাবে। আমি জানি, মানুষ কতটা স্নেহপ্রবণ! এও জানি-তোমার আপাত নির্বিকার দুচোখের আড়ালে থাকা ঝর্ণার উৎস হতে ওরা বঞ্চিত হবে না।
আমি জানতাম- তুমি সব জানো। তবু কোনোদিনও মুখফুটে তোমার কাছে স্বীকার করতে পারলাম না- আমি “তোমাদের নই”। আমার এ ব্যর্থতাকে ক্ষমা কোরো।
খুব ইচ্ছে করছে তোমার হাত ধরতে। জগতের সকল জড়তা দূর করে বিনা দ্বিধায় ‘তোমাদের নই’ বলে নিজেকে তোমার সামনে প্রকাশ করতে। খুব ইচ্ছে করছে তোমার নির্বিকার চোখদুটো আবার দেখতে। ভাবছি- এই চিঠি পড়ে ওখানে কি জমে উঠতে পারে বিন্দু বিন্দু স্বচ্ছজল? হয়তো না। বড় রহস্যময় তুমি! আমার জীবনে যা কিছু বড় পাওয়া- তার ভেতর এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া যে, ‘তুমি আমার বন্ধু’।
তুমি আমাকে উপহার দিয়েছো নিখাঁদ বন্ধুত্ব। আমি তোমাকে কী উপহার দিতে পারি? কোথায় যাব জানিনা, কিন্তু অপরিচিত জগতে যদি অনুভূতিশূন্য বিস্মৃত আত্মা না হই – তবে বহুদূরের সেই জগতেও তোমাকে আমি মনে রাখবো।

                                                                                                                     ___ইয়াসমীন।

পরিশিষ্ট :

ফজরের আজান হচ্ছে।

শুকতারা হারিয়ে যাচ্ছে।

বাতাসে উড়ে যাচ্ছে নীল খামের চিঠি।

আমার কোনো তাড়া নেই।

আমি বসে আছি, আমার মনে হচ্ছে – আমার সারাজীবন এমনি বসে থাকার কথা ছিলো, ভুল করে অন্য কোথাও কাটিয়ে দিয়েছি ভুল ঠিকানায়।

সুবহে সাদিকের পর ভোরের বাতাসের স্নিগ্ধতায় আমি ডুবে যাচ্ছি। আমি জেগে উঠছি, আমি হেঁটে চলেছি পাহাড়ী পথে – দুইপাশে ওগুলি কী চিনার বৃক্ষ – কাবুলের খরস্রোতা নদী? এই পাহাড়ের নাম কি কোহেকাফ? জানি না, কখনও জিগেশ করা হয় নি ইয়াসমীনের কাছে। পাহাড়ের কোন উপত্যকায় থোকায় থোকায় ফোটে “ইয়াসমীন ” যার ঘ্রাণে মুগ্ধ হয়ে ওর বাবা ওর নাম ইয়াসমীন রেখেছিলেন! আমি তাও জানি না। ভোরের সূর্য ওঠার আগে, আমি গিয়ে দাঁড়াতে চাই, সেই ঝর্ণা নহরের পাশে – কবে যেন বলেছিলো ইয়াসমীন – ওখানেই ওকে কবর দিতে বলবে…আচ্ছা, আগুনের জ্বীন- পরীদেরও কি কবর দিতে হয়? মানুষের মতই কি মিশে যায় মাটিতে ওরাও? জিগেশ করা হয়নি কখনও? চিরকাল শুনেছি পরীদের থাকে ডানা। ইয়াসমীনের ডানা ছিলো কি? কে জানে!

আমার কানে এখন দূরাগত কণ্ঠ ভেসে আসছে
কেউ যেন গাইছে…
'কোই দিনগর জিন্দেগানি আওর হে…
আপনি জি মে হামনে থানি আওর হে… '

ওটা তো ইয়াসমীনের কণ্ঠ…
বসন্তের বাতাসে ছিড়ে ছিড়ে যাচ্ছে…

Post a Comment

2 Comments

Sajib Hasan said…
<
দীর্ঘ গল্প পড়ার অভ্যাস নেই তবুও অনেকক্ষণ ধৈর্য্যধারণ করে পড়লাম। এক কথায় অসাধারণ